বাংলাদেশ থেকে একদল ভারত দখল করবে! হুম, পারবে! তিনশো টাকায় মাইক ভাড়া করে আর ফেসবুকে ফ্রিতে স্ট্যাটাস দিয়ে ভারতকে তো দখল করা যাবেই! যারা ভারত দখলের স্বপ্নে বিভোর তারা মাঝে মাঝে ভাত-টাত খাবেন! উল্টোপাল্টা জিনিস কত খাওয়া যায়! চারদিনে কলকাতা দখলে চিন্তা বাদ দিয়ে চারদিন দেশপ্রেমের চিন্তা করে চাষবাস করা মঙ্গলের হবে। ভারতের গদিবাদী মিডিয়ার মত যদি উল্টোপাল্টা বলতে শুরু করেন তবে আশরাফ আর আতরাফে তফাৎ রাখলেন কই? গুজবে নাকাল হয়ে কথায় হাল হারাবেন না!
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি বাংলাদেশের বিজয় দিবস নিয়ে তাদের পুরাতন বয়ান নতুনভাবে হাজির করেছেন! তাদের বিজয় দিবসকে সুমহান করেছেন! তাদের স্পষ্ট ভাষ্য ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত জয়লাভ করেছে! তারা যুদ্ধ করতে এসেছিল কবে সে সন তারিখ বোধহয় বেমালুম ভুলে গেছে! তাকে এবং তার অনুসারীদেরকেও বলবো- উল্টাপাল্টা জিনিস কম কম খেতে! শাকপাতা বেশি খাওয়া মস্তিষ্কের জন্য ভালো নয়! বোধহয় বেশি লবণ জল পান করছেন! যাই খান পরিশোধন করে পান করবেন! জীবানু ভয়ঙ্কর। মস্তিষ্ক বিকৃত করে দেয়।
এবার আসি আসল কথায়। ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে বাংলাদেশের দশমিক শতাংশও জয়ের সম্ভাবনা নাই! বাণিজ্যিকভাবেও আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। তারাও আমাদের ওপর নির্ভরশীল কেননা তারা বাংলাদেশে যে সকল পণ্য রফতানি করে তা এমন লাভজনকভাবে আর কোথাও বিক্রি করতে পারবে না। মোটকথা, বাংলাদেশের বাজার ভারতের কৃষক ও কৃষি বাঁচানোর জন্য দরকার। দু’দেশের সরকার এটা বোঝে। কাজেই ভারতের উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশের নামে যত হুমকি-ধমকি দেক, মিডিয়া যত গুজব ছড়াক তাতে পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ বন্ধ থাকে না!
ভারতের সেসব পণ্য আমাদের জন্য দেশপ্রেমের প্রশ্নে কেনা হারাম যেগুলোর বিকল্প আমাদের বাজারে আছে। ভারতীয় পণ্যের বিকল্প যে সকল পণ্য বাংলাদেশে উৎপন্ন হয় তা যদি মানে-গুণে কিঞ্চিৎ নিম্নতর হয়, দামে কিছুটা বেশিও হয় তবুও সেটা ক্রয় করা আমাদের দেশাত্মবোধের প্রশ্নে ফরজ। দেশপ্রেমের এই চেতনা ভারতের শত্রুতা সৃষ্টি করেছে। ভারত বাংলাদেশের প্রশ্নে যা শুরু করেছে তা বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত। দু’পক্ষেরই থামা উচিত। ভারতের লাগাম দেওয়া উচিত দ্রুতই। একেবারে স্থির বিশ্বাস রাখুন, ভুলেও ভারত বাংলাদেশের ভূখন্ডে সরাসরি আঘাত করবে না কেননা সীমান্তে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে ভারতের এখন কোন বন্ধু নাই। ভারতের অভ্যন্তরেই যায় প্রাণ অবস্থা! আমেরিকা-জোট ভারতের বিরুদ্ধে ভালোই খেলছে!
ভারত বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সীমিত করলে তাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে বটে কিন্তু ভারতের ক্ষতির মাত্রাও কম হবে না। শুভেন্দু অধিকারী এবং তাদের মতাদর্শের যারা ভোঁদড় ভোঁদড় করছে তাদের বাংলাদেশ নিয়ে যত মাথা ব্যথা তার চেয়ে বেশি নিজেদের দেশের ভোটের রাজনীতির হিসাব। উগ্রপন্থীদের থেকে ভোট আদায়ে ধর্মীয় ইস্যু সবচেয়ে বেশি কার্যক্রম। বিজেপি সেই ছকেই কথা বলছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে ভারতের ছিটেফোঁটাও মাথা ব্যথা নাই এবং কখনোই ছিল না, কেননা স্ব-জাতি তামিলদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন তারা কম করেনি। আর ভারতে মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দমন-দুর্দিনের কথা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। আপনি না জানলে জার্মানি সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের বয়ান পড়ে নিবেন।
যে দেশটি বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশি হয়েও বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তারা আমাদের বন্ধু নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ মন্তব্যে তিনি যা লিখেছেন, তাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আলাদা করে আদৌ স্বীকার করেন কিনা- তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে! নয়তো এদেশের নয়তো ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণ, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রম এবং অসংখ্য মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা তাদের বিজয় বলে দাবি করা নিছক গোঁয়ার্তুমি। বাংলাদেশে সরকারের উচিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের বিকল্প উৎস তালাশ করা এবং ভারত নির্ভরতা কমানো। পণ্য কিংবা বন্ধু- মাঝে মাঝেই পাল্টাতে হয়। তাতে রূচি ঠিক থাকে।
বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ, দেশপ্রেমিক জনতা যদি সজাগ ও সোচ্চার না হয় তবে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে। যে সকল ভারতীয় পণ্যের বিকল্প আমাদের বাজারে আছে সেগুলোতেই অভ্যস্থ হতে হবে। সবার আগে দেশের সম্মান। নিত্য ব্যবহার্য সকল ভারতীয় পণ্যের বিকল্প তৈরি করতে হবে। ভারত যদি বাংলাদেশকে তার করদরাজ্য বা অঙ্গরাজ্য মনে করে তবে সেটা ঐতিহাসিক ভুল হবে। অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমা করা যায় কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভুলের দন্ড আছে। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সাথে ভারতের ঐতিহাসিক যোগাযোগ আছে বটে কিন্তু ধাত্রী যখন অভিভাবকত্বের দাবি করে তখন তাদের উদ্দেশ্য নিন্দনীয় শোনায়। ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে বক্তব্য-বিবৃতিতে সাবধান হোক।
ভারতের বিকল্প চিকিৎসা কেন্দ্র আবিষ্কার করতে হবে। পর্যটনের গন্তব্য হিসেবে বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে বেছে নিতে হবে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের স্বনির্ভর হওয়া ছাড়া ভারতকে মোকাবিলা করার বিকল্প কোন পথ নাই। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ বছরব্যাপী ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র এবং কৌশল করে বাংলাদেশকে ভারতমুখী করে রাখা হয়েছে। এর সব দোষ ভারতের না বরং এদেশের দোসররাও তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ভারতকে প্রভূতুল্য জ্ঞান করেছে। এখন সময় এসেছে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশের মেরুদন্ড মেরামত করার। দেশের স্বার্থ ও মর্যাদার প্রশ্নে ভারত কিংবা পাকিস্তান- কোন পন্থী হওয়ার সুযোগ নাই। আমরা কেবল বাংলাদেশপন্থী হয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সুমহান-সমুজ্জ্বল করবো। বিজয়ের মাসে দেশপ্রেমের শপথে বলিয়ান হওয়া জরুরি।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
raju69alive@gmail.com