শিশুদের গড়ে না তুলে আমরা কোথায় ঢালছি টাকা ?

160
Print Download PDF

শিশুদের গড়ে না তুলে আমরা কোথায় ঢালছি টাকা ???
— ড. মুহম্মদ ইদ্রিছ ভূইয়া

ময়মনসিংহে শিশু একাডেমির নামে বরাদ্দ নেয়া একটি দালানের পিছনে পুকুরসহ অতি মুল্যবান বিশাল পরিত্যাক্ত প্রাঙ্গন হলো শিশু একাডেমির চিত্র । কিছুটা দুরে গগনচুম্বী মেট্রোপলিটন মেজিট্টেট কোর্ট ভবনের পাশে বিগত ক্ষমতাশীল দলের একজন প্রভাবশালী সাবেক পৌর কমিশনারের বাড়ীতে ভাড়া নেয়া দুইটি কক্ষে শিক্ষা, সাংস্কৃতিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় এই বিভাগীয় সহরের শিশু একাডেমি। যেখানে শিশুদের কোন আনাগোনা চোখে পড়ে না। যেন এই বিষয় কারো কিছু ভাবনার নেই, বলার নেই।

অন্যান্য শহরে শিশু একাডেমি কোথায়, তা খুঁজেই পাওয়া যাবে না, বা এর ঠিকানাও সাধারণ মানুষ জানে না। অথচ শিশু একাডেমি গুলো থাকার কথা জেলা সহরের সব স্কুল,কলেজে, মাদ্রাসা এবং সকল শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পাশাপাশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমির কাছাকাছি বিশাল এলাকাব্যাপী বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। দেশের প্রতিটি জেলায় ও কয়েকটি উপজেলায় শিশু একাডেমী থাকলেও
খুপরির মধ্যে একেকটি শিশু একাডেমি।

নুতন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে হলে আমাদের মৌলিক প্রতিষ্ঠান গুলোরও নতুন বিন্যাস দরকার। আমরা কেমন মানুষ চাই, তার ওপর নির্ভর করবে এই বিন্যাস। প্লাটো শিশুদেরকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পত্তি বলে গেছেন। আরো বলে গেছেন শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে শারীরিক ও মনের চেতনাবোধ মিলিয়ে। আর সেই চেতনার সঙ্গে জড়িত থাকে জীবন সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির গঠন প্রক্রিয়া। ফলে যাদেরকে তারা ভালবাসে, তাদের তারা অনুকরণ করে।

বড়দের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হয় বড়দের গল্প, কবিতা, রূপকথা শুনে। নিজেদের সেরা বন্ধুদের মধ্যে কে ভালো, কে খারাপ, এটা যখন শিশুর কাছে স্পষ্ট হয়,তখন সে সেই আচরণ অনুকরন করে।

শিশুবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুরা আট থেকে নয় ধরনের বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। কেহ প্রকৃতি দেখে শেখে, *কেহ তালে তালে শেখে, -কেহ গাণিতিকভাবে শেখে, *কেহ একা একা শেখে, +কেহ দল বেঁধে শেখে, *কেহ যৌক্তিকভাবে শেখে, *কেহ গানেগানে শেখে, *কেহ ছুঁয়ে ছুঁয়ে শেখে, আর কেহ কেহ সুন্দর স্থানে দেখে শেখে।

শিশু একাডেমির কাজ সব শ্রেনীর শিশুর মনে জীবনের ঠিকানা কি হবে তা প্রোথিত করে দেয়া । শহরের শিশুকে গ্রামে আর গ্রামের শিশুকে শহরে নিয়ে আসা। উপজাতি, নৃগোষ্ঠীর শিশুদের সাথে শিশুমেলা করে শিশুদের দেশের সকল মানুষের ঐক্যের বীজ বুনে দেয়া ।

এতে শিশুরা পরস্পরের সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। শৈশব থেকেই শিখতে পারে বাংলাদেশ মানে শুধু তার গ্রাম বা শহর নয়। বাংলাদেশ বহু জাতি, বহুভাষী ও বহু ধর্মের মানুযের মিলেমিশে থাকার একটি দেশ। অতএব জাতীয় ঐক্যের রাষ্ট্র যদি গড়ে তুলতে হয়, তাহলে এই মেলার বিকল্প নেই।

শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে জমে উঠতে পারে বইমেলা। যেখানে শিশুরা শিখবে ফটোগ্রাফি, সিনেমা কোর্স, গান, গল্প বলা, নৃত্য, আবৃত্তিসহ যা কিছু শেখার সবকিছু। শিল্পকলা একাডেমি যেমন কেবল সব ধরনের শিল্পীদের। শিশু একাডেমি তেমনটা নয়। শিশু একাডেমি কেবল শিশুদের, জেলার শিশুর। সেখান থেকে তারা নিজ জেলাটিকে শীর্ষে গড়ে তুলবে এবং ভালোবাসতেও শিখবে।

সমাজে বিত্তবানদের মধ্যে এই মানবিক বিষয়টির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে তাদের অনুদানে প্রত্যেকটি জেলায় শিশু একাডেমির জন্য দ্বিতল বাস এবং নিম্নাঞ্চলের জেলা গুলির জন্য সুসজ্জিত লঞ্চ সংগ্রহ করতে পারে। যার মধ্যে ছোটখাটো জাদুঘর বানাতে পারে। ওই বাস লঞ্চ গুলোয় শিশুরা সারা বছর ঘুরবে। একেক দিন একেক স্কুল, কখনো কয়েকটা স্কুল একসঙ্গে। দেখবে এবং ভাববে ঐতিহাসিক মসজিদ,মন্দির, গীর্জা, প্যগোডা এই গুলি কি এবং কেন ।

শিশুরা আগ্রহী হয়ে বিষয়ভিত্তিক ক্লাব গড়ে তুলবে।
সাইক্লিং বা স্কেটিং ক্লাবের সদস্যরা সাইকেল চালানো শিখবে, প্রতিযোগিতা করবে। সাহিত্য ক্লাবের শিশুরা সাহিত্য নিয়ে দেশসেরা লেখকদের কথা শুনবে, একাডেমির সহযোগিতায় প্রকাশিত পত্রিকায় লিখবে। যারা ছবি আঁকবে, তাদের চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন হবে। ফটোগ্রাফ ক্লাবে ফটোপ্রদর্শনী হবে বিজ্ঞান ক্লাবে বিজ্ঞানমনস্কতার আলোচনা হবে।

আমাদের নদী, জলাশয় শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস আকাশ ছোঁয়া হচ্ছে, ক্রমশ দৃষ্টি নন্দন হচ্ছে। ব্রিজ-কালভার্ট দেখবাল করার নেই অথচ এলজিআরডির অফিস তিলোত্তমা হচ্ছে। কেরানিগিরি হয় যে প্রশাসনিক অফিসে যেখানে সেবার মান দুঃজনক অথচ অফিসগুলো প্রতিযোগীতায় চকচক করছে। আর যে হাসপাতালে লাখো মানুষের জীবন নিয়ে কাতরানো,তার ভবন কত দৃষ্টি নন্দন করা যায় এর চেষ্টা, অথচ সেখানে রোগীর বিছানা না থাকার বিষয়টি অবহেলিত।

পৃথিবী বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ ‘লুই কান’ যিনি মানুষের সুখের দালানকোঠা, স্বপ্নের বাড়ি ঘর কিভাবে তৈরি করা যায় এনিয়ে আজীবন চিন্তা করেছেন। তার
বই Silence and Light পড়লে বুঝা যায় শ্রেষ্ঠ তারাই যারা বুঝে এবং অনুসরণ করে মানবদেহ প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির প্রভাব তার মধ্যে বিদ্যমান। অতএব প্রকৃতিই তার চালক। তাই প্রকৃতির পরিবেশে প্রতিটি শিশুকে গড়ে তুলাই উত্তম যাতে শিশু বয়সেই সে তার জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য কি হবে তা বুঝতে শুরু করে।

লাখ লাখ শিশু নিয়ে কার্যক্রম যে শিশু একাডেমির, সেই শিশু একাডেমি এত খুপরির মতো যে কারও চোখেই পড়ে না। অথচ মানব সভ্যতার দাবী পুরন করতে হলে প্রতিটি জেলার সবচেয়ে বড়,সবচেয়ে দৃষ্টি নন্দন ভবন হওয়ার কথা শিশু একাডেমির।

-লেখক একজন মুক্তিযোদ্ধা, আইন ও সমাজ সেবায় শেরেবাংলা পদক প্রাপ্ত,এডিবি ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের নগর ও সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক সাবেক কনসালটেন্ট।
মোবাইল – ০১৭২৮০৬৯০৩০
ইমেইল – idris_bhuiyan@yahoo.com