একই কথা সুন্দর করেও বলা যায়, আবার তিতা করেও। অথচ চাইলে আমরা কাউকে ব্যথা না দিয়েই নিজের কাজটা করে নিতে পারি। মানুষ ভালো কথা মনে রাখে, সুন্দর আচরণ মনে ধরে। কিন্তু খোঁচা দেওয়া, ব্যথা দেওয়া কিংবা মনঃকষ্টের কারণ হলে, তা অনেক গভীরভাবে গেঁথে থাকে হৃদয়ে। তখন একসময় পাই পাই করে হিসেব নেওয়ার বাসনা জাগে। তিক্ত কথায় হৃদয়ের সুপ্ত ভালোলাগা নিঃশেষ হয়ে যায়। দূরত্ব বাড়ে। আমরা চাইলে ভালোবাসা অর্জন করতে পারি, আবার ঘৃণাও কুড়াতে পারি— এই ব্যবধান তৈরি করে আমাদের ব্যক্তিত্বের স্বকীয়তা।
একজন মানুষকে আমরা কী দেখে বিচার করি? রূপ? চেহারা? এসব প্রশংসা পায় বটে, তবে তা চিরস্থায়ী নয়। মানুষকে সত্যিকারে মুগ্ধ করে তার ব্যক্তিত্ব। রসকষহীন কথা, কঠিন ব্যবহার যাদের—তাদেরকে সবাই এড়িয়ে চলে। যার জিহ্বায় ভদ্রতা নেই, আচরণে নেই লজ্জা—সে আসলে সঙ্গী ও সঙ্গের বোঝা। জীবনে এমন অনেকে থাকে, যাদের এড়ানো যায় না বলেই সঙ্গে থাকতে হয়। কিন্তু যাদের সঙ্গ মানসিক প্রশান্তি দেয়, যাদের আচরণ আপন করে, যাদের চোখে-মুখে থাকে সম্মান আর হৃদয়ে থাকে দরদ—তাদের সহজে ভুলে যাওয়া যায় না।
মানুষ আসলে আটকে যায় ব্যবহারে, আবার ছিটকে যায় তাতেই যদি ব্যবহারে ভর করে স্বার্থ। কারো কাছে আমরা টাকা-পয়সা বা সম্মান চাই না; চাই মুখের মাধুর্য, আচরণের ভদ্রতা। যাদের আপন ভাবি, তারা অনেক সময় রক্তের সম্পর্কেও সম্বন্ধিত নয়। কারো সঙ্গে হয়তো কোনোদিন দেখাই হয়নি, তবুও আত্মার সঙ্গে আত্মার মিল ঘটে যায়। মনের মিল, মতের মিল মানুষকে একসাথে এক ছায়ায় নিয়ে আসে, ভালোবাসায় বেঁধে রাখে— যা আমরা হরিহর আত্মাদের মধ্যে দেখতে পাই।
ছোটকে মূল্যায়ন না করা, বড়কে সম্মান না দেখানোয় বড় কতখানি ছোট হয়, সে আলোচনা থাক। তবে এতে নিজেকে ছোট করেই ফেলা হয়। নত হওয়ায় ক্ষতি নেই; বরং তাতে বাড়ে সম্মান। ভুল স্বীকার করলে সম্মান বাড়ে, বেড়ে যায় ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্য। কৃতজ্ঞ থাকা, আগলে রাখা—এসবই মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ। বিপদে পাশে থাকা সবার ভাগ্যে জোটে না। উপকারে না আসা দোষের নয়, কিন্তু কারো ক্ষতির কারণ হওয়া গভীর পাপ। উপকার যদি করতেই হয়, তবে তা হোক নিঃস্বার্থে। শর্তসাপেক্ষ সাহায্য আসলে এক ধরনের লেনদেন। অথচ উপকার এমন হওয়া উচিত, যেন তা হয়ে ওঠে সদকা।
জীবনে কাউকে ঠকানোর মতো পাপে জড়ালে তার পরিণতি অনিবার্য—ধ্বংস। কারো অভিশাপ কিংবা দীর্ঘশ্বাসে জীবন জড়িয়ে গেলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। বরং মানুষের দোয়া কুড়াতে পারাই বড় প্রাপ্তি। কোনো এক প্রান্তে কেউ প্রশংসা করছে—এই অদেখা প্রশংসাটাই জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ভালো কাজের ছাপ রেখে গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও তা উপভোগ করতে পারে। সম্পদের দখলের চেয়ে কারো হৃদয়ের দখল অনেক গুণে মহৎ। মানুষ তো আজ আছে, কাল নেই। তাই কারো মনের কোণে নীরবে বেঁচে থাকাই জীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।