মানুষের মূল্য তার পদের মধ্যে নয়, থাকে তার পরিপূর্ণতার স্বপ্নে। বড় চাকরির চেয়ার, মোহনীয় পদ কিংবা বাহ্যিক আড়ম্বর—এসবের মোহে মানুষ বড় হয় না, বরং ক্ষুদ্র হয় তার চিন্তায়, সংকুচিত হয় তার সততায়। স্বকীয়তার আলো যখন লোভের ছায়ায় ঢাকা পড়ে, তখন মানুষ নিজেরই প্রতিচ্ছবিতে অপরিচিত হয়ে ওঠে।
কত উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, কত উচ্চস্বরে কথা বলেন, অথচ হৃদয়ের ভেতর লুকানো থাকে নীতিহীনতার নীরব কান্না! বড় সাহিত্যিক হওয়া সহজ, কিন্তু মহান সাহিত্যিক হয়ে ওঠা বোধের, নীতির এবং আত্মসংযমের পরীক্ষা। তেমনি ভাইরাল দানবীর কিংবা শোরগোল তোলা সমাজসেবী হতে সময় লাগে না, কিন্তু নিভৃতে মানবিক হওয়া—সেটাই বিরল সাধনা।
জীবনের গৌরব থাকে আত্মমর্যাদায়, নতশিরে নয়। অন্যায়ের আবদারে যাঁরা কুর্নিশ করেন, তাঁরা নিজেই নিজেদের ছোট করেন। বেঁচে থাকা যায় নির্লোভ, নির্লিপ্ত এবং নির্মোহ এক জীবনেও—যেখানে মাথা উঁচু থাকে, চোখে থাকে দীপ্তি, হৃদয়ে থাকে শান্তি। একজন সৎ মানুষ কাউকে অনুরোধ করেন না, কাউকে তোষামোদও করেন না। তাঁর নীরব উপস্থিতিতেই থাকে সম্মানের ঔজ্জ্বল্য।
ক্ষমতার অহংকার ক্ষণস্থায়ী; দম্ভের ধোঁয়া সহজেই মিলিয়ে যায় সময়ের বাতাসে। কিন্তু যিনি বিনয়ী, যিনি ন্যায়ের অনুগামী, তিনি থাকেন চিরন্তন বটবৃক্ষের মতো, যাঁর ছায়া খুঁজে ফেরে ক্লান্ত পথিক। সৎ মানুষ অন্যের ক্ষতির কথা ভাবে না, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে না। ফলে জগতের অলিখিত নিয়মেই তাঁর চারপাশে গড়ে ওঠে এক অনন্ত শান্তির বলয়।
জীবনের সার্থকতা শুধু বিলাসে নয়, থাকে বিবেকের প্রশান্তিতে। প্রয়োজনীয় যা কিছু, যদি তাতে বারাকাহ থাকে, তা-ই যথেষ্ট। কারণ বিত্তে সুখ নয়, চরিত্রে তৃপ্তি। আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচার মধ্যেই প্রকৃত কৃতিত্ব, কারণ তা দিয়ে শুধু নিজের নয়, সমাজেরও মুখ উজ্জ্বল হয়।
যারা নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে ক্ষমতার সান্নিধ্যে অহংকারের সাজে রাজার বেশে ঘুরে বেড়ান—তাঁরা মরার আগেই মরে যান। কিন্তু যাঁরা নিজেকে সত্য, ন্যায় আর বিবেকের পথিক বানিয়ে ত্যাগের পথ বেছে নেন, মৃত্যুর পরেও তাঁদের নাম বেঁচে থাকে, ছায়া হয়ে মানুষের মঙ্গল করে।
এই একজীবনে যদি কিছু অর্জন করতে হয়, তবে হোক তা এমন, যাতে নাম শুনেই হৃদয়ে ভালোবাসা জাগে, ছায়া দেখেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আত্মমর্যাদা বাঁচিয়ে রেখে আত্মপরিচয়ের দৃষ্টান্ত হতেই হবে—এটাই হোক জীবনের প্রতিশ্রুতি।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।