সময় পক্ষে না থাকলেই ভাগ্যকে দোষারোপ করি? ক’জন মানুষকে পাবেন যারা তাদের অবস্থানে সন্তুষ্ট? ক্ষুধা তো মোটে মেটে না। আরও চাই রোগে সুখ খোওয়া যাচ্ছে। বুক পকেটে টাকা রেখে হাত দিয়ে চেপে রাখি অথচ সেই পকেটটার একটু নিচেই গোটা একটা হৃদয় ছিল—কতটুকু যত্ন করেছি? অল্পে সন্তুষ্ট না হওয়ার ব্যাধিতে দিনকে দিন আমাদের প্রশান্তি খোওয়া গেছে। ভোগের ক্ষুধায় দ্বিকবিদিক পাগলের মত ছুটতে ছুটতে কবরের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। অথচ যা আছে, তাতেও যে সন্তুষ্ট থাকা যেত— একবারও নিজেকে বোঝাইনি।
সুখের অনেকটাই মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে নির্ভর করে। অন্যের সাথে তুলনা করে নিজেদের অবস্থা-ব্যবস্থা পরিমাপ করি। আমি যে সে না— এই বোধটুকু আমাদের মধ্যে থাকে না। অন্যের আছে, তাই আমারও লাগবে— এমন শূন্যতায় মনেপ্রাণে মরে যাই। হা-হুতাশ, বিষণ্ণতায় শান্তির কবর রচনা করি।
মানুষের কত লাগে? কত আর মানুষ ভোগ করতে পারে? খালি অভাব অভাব বলে মানুষের মনে যে বাতিক তৈরি হয়, সে বাতিক তাকে আর মৃত্যুর আগে ছাড়ে না।
নিজের পজিশনে সন্তুষ্ট না থাকা সমাজে ব্যাধির পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওপারে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস— বলে বলে নিজের অবস্থানকে অপমান করার রোগ আমরাই তৈরি করেছি। মানুষ অন্যের বাহ্যিকতার চাকচিক্য দেখে নিজের জন্য আফসোস করে, অথচ তাদের চাপা দুঃখ কখনো দেখে না। কারো ঘুরতে যাওয়া দেখে, কারো বাহারি ছবি তোলা দেখে কিংবা কারো গহনা-শাড়ি দেখে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করে। অথচ আসল সুখ কীসে, তা বাবুই পাখি জানে। অধিকাংশ মন খারাপের কারণ নিজে, নয়তো আপন মানুষ।
দূরের মানুষ ততটা ব্যথা দিতে পারে না, সুযোগও নাই। আমি পেলাম না, তবে সে কেন পেল— ভাবনায় দিনের আনন্দ খোওয়া যায়। সুখ তো আসলে অল্পে। বহুর সাথে গল্প জমে না। অধিকের সাথে সম্পর্কের গভীরতা জমে না। অনেক শাড়ি, প্রচুর গহনা কিংবা একাধিক ঘড়ি—এর কোনোটাই বিশেষ হতে পারে না। মানুষ ও অর্থ-বিত্তের ক্ষেত্রেও একই সূত্র প্রযোজ্য। কোনোকিছুই মাত্রাতিরিক্ত সুফল আনে না। সম্পর্কের গভীরতার জন্য সাথে থাকতে হয়।
জীবনকে ইনজয় করতে হবে। কোনোকিছুর পেছনে মাতালের মত ছুটলে শেষ বেলায় সেসব কোনো কাজে আসে না। অর্থও প্রয়োজন, আবার অবসরও প্রয়োজন। অর্থের নেশা যেন অবসরকে ছাপিয়ে না যায়। টাকা যেন সুখকে মেরে না ফেলে।
আমরা একবার একটাই জীবন পাই। সেটাকে কীভাবে খরচ করবো— সে সিদ্ধান্ত আপন আপন। মহাপরিকল্পনাবিদের পরিকল্পনার বাইরে আমরা কেউই যেতে পারি না। তবে অনেকক্ষেত্রেই আমাদের অশান্তির কারণ আমরাই ডেকে আনি। অন্যকে ঠকিয়ে পাপ করি কিন্তু মাফ চাই না। নত হওয়ার শিক্ষা, অহংকার-দম্ভ থেকে দূরে থাকার বোধ আমাদের অনেকের থাকে না। প্রত্যেকটি অন্যায়-অপরাধ মনের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। প্রায়শ্চিত্তবোধ জাগ্রত করে কিন্তু তখন অনেক দেরি। অল্পে তুষ্ট থাকলে হৃদয় প্রফুল্লচিত্তে থাকে। তখন ভালো থাকা সহজ হয়। আমরা বোধহয় ভালো থাকার জন্যই বাঁচি।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।