চাকরি মানে চাকর-ই! “আমার চাকরি বড়, আর তোমারটা ছোট”—এই বিতর্ক ও বিভাজন মোটামুটি আহাম্মকি। শখ, স্বপ্ন ও স্বাধীনতা বিক্রি করে অর্জিত দাসত্বের কথা কেউ বুক ফুলিয়ে বলে! আমার চাকরি বড় মানে আমি সেরা চাকর? অর্থের বিনিময়ে যে খাটুনি, তা নিয়ে আসলে অহংকারের কিছু নেই।
বেঁচে থাকার তাগিদে যে ঘানি টানি, সেই একই ঘানি তো গাঁধাও টানে—মালিকের কাছ থেকে কিছু ঘাসের আশায়। কাজেই কামলাগিরিতে আমি আশরাফ, আর তুমি আতরাফ—এমন লকব যারা ঝুলায়, তাদের বোধে ধুলা জমেছে।
মানুষকে হেয় করে দেখার যে পৈশাচিকতা, তা মানুষের মনে ভালোভাবেই বাসা বেঁধেছে। অন্যকে খাটো করে যে হাসে, সে প্রকৃতিগতভাবেই ক্ষুদ্র। ন্যায়বিচার এখনো জীবিত। নিজেকে বড় দেখাতে গিয়ে কাউকে অবজ্ঞা-অবহেলা করে কথা বললে ইজ্জত বাড়ে না।
কে কোন চাকরি করে, সেটাতো দুনিয়ার হিসাব! তবে ইজ্জতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। কথিত বড় বড় চাকরি করেও কতজন কতভাবে অসম্মানিত হয়েছে, পেরেশানিতে পড়েছে কিংবা জেল-জরিমানার ঘানি টেনেছে—তার দৃষ্টান্ত এই দেখা দুনিয়াতেই কি কম?
সম্মান আর ভয়কে কখনো এক করে দেখো না। কেবল টাকা, শুধুই ক্ষমতা—এসব অসুস্থদের উদঘাটিত আরাধনা। যে কর্মে চিন্তার বিস্তৃতি নেই, অন্যের কল্যাণ নেই, জাতির মঙ্গল নেই—সে কর্মের সঙ্গে জড়িতদের সম্মানিত ভাবার কোনো সুযোগই নেই।
চেয়ার বড় হতে পারে, ক্ষমতার পরিধি বিস্তৃত হতে পারে—তবু ছোটলোকি সহজে যায় না। পদ-পদবি চলে গেলেই যাদের দিন ফুরায়, অবসরে গেলেই যাদের সম্মান শেষ হয়ে যায়—তাদেরকে বড় ভাবার অবকাশ কোথায়? দায়িত্বে থাকাকালীন প্রাপ্ত সালাম এবং ক্ষমতাহীন দিনগুলোতে আকাঙ্ক্ষিত সালাম দিয়ে সম্মান মাপতে হয়।
ভালো কাজ করলে সুইপারও উত্তম। খারাপ কাজ করলে মন্ত্রীও অধম। সম্মান সবসময় সততার সাথে জড়িত। “কার চাকরি বড়” এই তুলনা বাদ দিয়ে “কে মানুষ হিসেবে বড়”—এই ভাবনায় গর্ব হোক।
দিনশেষে মানুষের কর্মের মূল্যায়ন হবেই। না হলে তো শেষ বিচারের অপেক্ষায় একটা জীবন পাড়ি দিতে হতো না। অর্পিত দায়িত্ব পালনের মাঝেই কৃতিত্ব আছে।মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করাতেই শ্রেষ্ঠত্ব।
দুদিনের ক্ষমতা পেয়ে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে, মানুষের অর্থ তছরুপ করেছে কিংবা কারো অধিকার হরণ করে তাকে ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছে—বিবেকের দহন ও দংশন তাদের ছাড়েনি। মানসিক অশান্তি, পারিবারিক যন্ত্রণা এবং সামাজিক ঘৃণার চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু কি আছে? “লোকটি অসৎ”—এই গালিই এক জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্ট অর্জন।
বড় চাকরি সেটা—যেখানে যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব, সে তা সঠিকভাবে পালন করে। যে ফাঁকিবাজ, দুর্নীতিবাজ ও চিন্তায় অসৎ—সে যে কাজই করুক না কেন, সেটা কখনোই মহৎ কর্মের স্বীকৃতি পাবে না।
আমার স্বাধীনতা সস্তায় বিকিয়ে দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করবার সুযোগ নেই। জীবিকা নির্বাহের জন্য যা করি, তা দাসত্ব-গোলামি। কাজের বাধ্যবাধকতা যদি শখ ও স্বপ্নের গতিপথ পাল্টে দেয়, তবে তা নিয়ে বাহাদুরি করা নিছক মূর্খতা।
দিনশেষে আমরা চাকরই। যারা নিজেরাই নিজেদের বস, তারা গর্ব করতে পারে—বলতে পারে, “তোমার চেয়ে আমি কিছুটা হলেও বড়।” কিন্তু যারা অন্যের অধীন, তারা নিজেদের মাঝেই আবার বিভাজন করে উঁচু-নিচু জাহির করতে চায়—যা হাস্যকর। চিন্তায় বড় মানুষ হতে হবে।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।