অনলাইন ডেস্কঃ বাংলাদেশে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনও পূর্ণ ঐক্যমত্য তৈরি হয়নি। সংসদে একটি উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস, মেয়াদ নির্ধারণ এবং একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনসহ মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলোতে প্রধান প্রধান দলগুলো বিপরীত অবস্থানে রয়েছে।
উচ্চকক্ষ নিয়ে মতবিরোধ
বেশিরভাগ দলই সংসদে একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কাঠামো চায়। তবে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে তীব্র মতানৈক্য। বিএনপি চায়, নিম্নকক্ষে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে উচ্চকক্ষেও আসন পাবে। অপরদিকে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মতে, এমন বণ্টন হলে উচ্চকক্ষের আলাদা প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে যায়।
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, আইন ও বাজেট প্রণয়ন হবে কেবল নিম্নকক্ষে। উচ্চকক্ষ শুধুমাত্র সাংবিধানিক সংশোধনসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অংশ নেবে। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ একাধিক দল ভোটের শতকরা হারে আসন চায়। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চায়, নিম্নকক্ষে বর্তমান ‘ফাস্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতি থাকলেও উচ্চকক্ষে আনুপাতিক পদ্ধতি প্রযোজ্য হোক। এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে প্রায় ২১টি দল।
সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ
সংবিধান ও অন্যান্য খাতে সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। বিএনপি চায়, ঐকমত্যভিত্তিক একটি ‘জুলাই সনদ’ হোক এবং পরবর্তী সংসদে সেই ভিত্তিতে সংস্কার প্রণয়ন করা হোক। জামায়াত মনে করে, আদালতের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার হওয়া উচিত। এনসিপি চায়, একটি নির্বাচিত গণপরিষদের মাধ্যমে এই পরিবর্তন আসুক, যা পরবর্তীতে সংসদীয় আইনে পরিণত হবে।
এনসিসি গঠন নিয়ে বিভাজন
প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র নিয়োগক্ষমতা সীমিত করতে প্রস্তাব করা হয়েছে একটি ৯ সদস্যের জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)। এতে রাষ্ট্রপতি, বিরোধী দলীয় নেতা, প্রধান বিচারপতি এবং সংসদ সদস্যরা থাকবেন। বিএনপি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ এতে অনির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার ঝুঁকি দেখছে তারা। জামায়াত এবং এনসিপি এনসিসির পক্ষে থাকলেও তাদের রয়েছে শর্তসাপেক্ষ সমর্থন।
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও ক্ষমতা
কমিশনের প্রস্তাব, কেউ যেন টানা দুইবার এবং সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। বিএনপি চায়, টানা দুই মেয়াদের বেশি নয়, তবে বিরতির পর আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে। জামায়াত চায় সর্বোচ্চ ১০ বছর মেয়াদ। এনসিপি প্রস্তাব করেছে, প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা পদে না থাকলেও চলবে। সব দলই প্রধানমন্ত্রীর কিছু ক্ষমতা কমাতে চায়, তবে কার মাধ্যমে তা করা হবে, সে বিষয়ে তাদের অবস্থান ভিন্ন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে একমত
সব দলই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথক সচিবালয়ের পক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে নিম্ন আদালত আনায় সম্মত। তবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে মতানৈক্য রয়েছে। বিএনপি চায় জ্যেষ্ঠ তিন বিচারপতির মধ্য থেকে নির্বাচন, জামায়াত ও এনসিপি চায় সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকেই প্রধান বিচারপতি করা হোক।
অন্যান্য মতপার্থক্য
- জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটদাতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে বিএনপি ও জামায়াত একমত নয়, তবে এনসিপি সমর্থন জানিয়েছে।
- বিএনপি স্থানীয় উন্নয়ন পরিষদে এমপিদের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে।
- যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ গৃহীত হলে রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবে জামায়াত একমত হলেও বিএনপি বিরোধিতা করেছে।
উপসংহার
এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক বিষয়ে আংশিক ঐক্যমত্য রয়েছে, তবে মৌলিক সংস্কারগুলো—যেমন উচ্চকক্ষের কাঠামো, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও মেয়াদ, এবং এনসিসি গঠন—এতে দলগুলো একে অপরের বিপরীত অবস্থানে রয়ে গেছে। দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে ছাড় ও সমঝোতার ভিত্তিতে ঐকমত্যের দিকে এগোনো সম্ভব কি না, তা-ই এখন দেখার বিষয়।