
পুরুষের অনেকেই যেন রীতিমতো “বউ ব্যবসা”র মানসিকতা নিয়েই বিয়ে করে। তাদের কাছে বউ যেন ব্যাংক, আর শ্বশুরবাড়ি একটি ভল্ট। শিক্ষার হার বাড়লেও সমানুপাতিক হারে বেড়েছে যৌতুকলোভী পুরুষের সংখ্যা। স্বামী যতই প্রতিষ্ঠিত হোক, বউয়ের বাবার বাড়ি থেকে চাই-ই-চাই—এসি, খাট, ফ্রিজ, ব্যবসার পুঁজি কিংবা গাড়ির চাবি। পারিবারিক শিক্ষার অভাবে ও আত্মসম্মানবোধের সংকটে যৌতুকগ্রহণ যেন অনেকের জন্য সাধারণ চর্চা হয়ে উঠেছে। অথচ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোনো পুরুষ এসব চাইতে পারে না। এমনকি স্ত্রী চাইলেও তাকে সম্মতি দেওয়া উচিত নয়। যারা যৌতুক গ্রহন করে তারা মূলত বিয়ে নয় বরং শ্বশুরবাড়ি লুটের পরিকল্পনা করে!
দেশের অধিকাংশ পরিবারেই অভাব রয়েছে। রোজায় ইফতারি, ঈদে জামাকাপড় কিংবা ঘরের আসবাব—এসব নিয়েও চলে দরকষাকষি। এমন মানসিকতার মানুষের সংস্কার দরকার। নারীর যত চোখের পানি, তার অধিকাংশই যৌতুক সংক্রান্ত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ফল। সংসারে অশান্তি, সন্তানের বিকাশে বাধা—সবকিছুর পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আছে যৌতুকের কুপ্রভাব। শ্বশুরের থেকে বিছানা-আলমারি এনে, সেগুলোর উপর শুয়ে গল্প করার মানসিকতা যেন পুরুষ পরিহার করে।
একজন নারী অপরিচিত পরিবেশে গিয়ে যখন শাশুড়ি-ননদ বা প্রতিবেশীর কাছে যৌতুক নিয়ে খোঁটা শোনে, তখন তা কেবল হৃদয়বিদারক নয়—মানবতার বিরুদ্ধেও। অযোগ্য পুরুষই যৌতুকের জন্য লোভী হয়। যাদের আত্মসম্মান আছে, তারা সামান্য সুতাও যৌতুক হিসেবে নিতে পারে না।
মানসিকতা বদলাতে হবে। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে লোভের কাছে আত্মসমর্পণ কোনো গৌরব নয়। বরং তা একধরনের নৈতিক দেউলিয়াপনা। যে জামাই শ্বশুরপক্ষে হাত পাতে, সে আর সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। রমণী যদি মুখরা হয়, তবে সারা জীবন তাকে এই বিষয়গুলোতে বহু কথা শুনতে হয়। অথচ একজন পুরুষের উচিত নিজ যোগ্যতায় পরিবারের প্রয়োজনীয় আসবাব গড়ে তোলা। এমন না যে, ফ্রিজ, টিভি কিংবা গাড়ি জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। সহজভাবে জীবন পরিচালনায় যা কিছু সহায়ক তা যৌতুকে নয় নিজের সামর্থ্যে সংগ্রহ করতে হবে।
মাটিতে পাটি বিছিয়ে থেকেও সম্মান নিয়ে বাঁচা যায়। কিন্তু ভিক্ষার মতো যৌতুক এনে বিলাসিতা করা কখনো গৌরবজনক নয়। এভাবে যে পুরুষ যৌতুক নেয়, সেই পুরুষই ভবিষ্যতে হবে একজন কন্যার বাবা। তখন বুঝবে যৌতুক দেওয়া কত কষ্টের, কত অপমানের, কত দীর্ঘশ্বাস জমে থাকে সে প্রক্রিয়ায়। অথচ যদি বিবেক দিয়ে নিজের বিয়ের আগেই এসব উপলব্ধি করা যেত—তবে সমাজ ও সংসার আরও শান্তিময় হতে পারত।
যৌতুকের কারণে কত মেয়ে আত্মহত্যা করেছে, কত সংসার ভেঙেছে, কত শিশু এতিম হয়েছে—তার হিসাব নাই। খুনজখম আমাদের সমাজে এখন প্রায়ই যৌতুকঘটিত কারনেই হয়। যৌতুক এই সমাজের একটি ভয়াবহ অভিশাপ। এটি প্রতিরোধ না করতে পারলে এর কুপ্রভাব থেকে কেউই মুক্ত থাকতে পারবে না।
এই প্রেক্ষাপটে যৌতুক নিরোধ আইনের কঠোর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে ‘যৌতুক নিরোধ আইন’ প্রণয়ন করেছে, যেখানে স্পষ্ট বলা আছে— “কোনো ব্যক্তি কন্যা পক্ষ হতে যৌতুক দাবি করলে বা গ্রহণ করলে, তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এজন্য তাকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।” এছাড়া, উপহারের নামে বা রেওয়াজ অনুযায়ী কিছু দেওয়া হলেও যদি সেটি প্রত্যাশা বা সামাজিক চাপের ফলে হয়—তবুও তা যৌতুকের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে।
যারা উপহারের নামে দিতে চায় কিংবা দিতে পারে, সেটা সমাজের জন্য মন্দ নয়। কিন্তু যখন সেটি রেওয়াজে পরিণত হয় এবং প্রাপ্যতার চাপ তৈরি করে, তখন তা একপক্ষকে অন্যপক্ষের কাছে দাসত্বে বাঁধে। কন্যাপক্ষ অনেক সময় উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে জামাই নামক অথর্বদের খুশি রাখতে বাধ্য হয়। এমনকি জামাই যদি সত্যিকারের প্রয়োজনে ধার নেয়, তাও যেন শ্বশুরের কাছ থেকে না হয়।
আমাদের সমাজে লোভী অমানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যৌতুক আজকের দিনে আধুনিকতার মুখোশে মোড়ানো এক অসভ্য রীতি। এর ফলে নারীর প্রতি মানসিক যন্ত্রণা ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। যৌতুক নামক অনাচার থেকে সমাজ-সংসারকে মুক্ত করতেই হবে। মেয়ের অশ্রুতে গড়া যৌতুকের সাম্রাজ্যের অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্ত থাকুক।
সরকার যেন এই ব্যাপারে আইন প্রয়োগে আরও কঠোর হয়—এটাই সময়ের দাবি। সমাজ যেন সচেতন হয়ে বলে, “বিয়ে হোক সম্মানে, নয় অর্থের লেনদেন।”
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।