নিজেকে অবিকল্প কিংবা অপরিহার্য ভাবার কারণ নাই। আপনি ছাড়াও কোনো কিছুই থেমে থাকবে না। যেদিন আপনি ঘুম থেকে আর জাগবেন না, সেদিনও সূর্য উঠবে। যেদিন আপনি থাকবেন না, সেদিনও এই ধরণীতে বাতাস বইবে। নিজেকে খুব দামী ভেবে কথায় কথায় যে হুংকার দেন—তা আসলে নিরর্থক। আপনি ছাড়াও সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলছে এবং চলবে।
যে প্রিয়জন বলে, ‘তুমি ছাড়া বাঁচবো না’, সেও দিব্যি বেঁচে থাকে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভেবে বসে থাকলে, দম্ভ-অহংকার জমালে তাতে পরের নয়, নিজেরই ক্ষতি। বিশ্বাস না হলে ডুব দিয়েই দেখুন। দু’বেলা আপনাকে স্মরণ থাকতে পারে; তৃতীয় বেলায় প্রিয়জনও বিলকুল ভুলে গিয়ে উৎসবে মাতবে। নিজেকে নিরঙ্কুশ ভাবা কেবল কল্পনার জগতেই সম্ভব—বাস্তবতায় এর চার আনাও মূল্য নাই।
কেউ না থাকলে হবে না, সম্ভব না কিংবা পারবে না—এমন কাজ জগতে একটাও নাই। ‘কারো শূন্যতা পূরণ হবে না’—এ কথা যতটা আবেগিক, ততটাই অবাস্তবিক। ‘আমি’ হয়তো ‘তুমি’ না, কিন্তু তোমার মতো বুঝি না তা তো নয়। জয়ের কৌশল অনেকেই জানে; এক পক্ষকে তো হারতেই হবে। টিকে থাকার লড়াইয়ে বড়াই করে সম্মান পায় না।
মানুষের সক্ষমতার সাথে ভাগ্য সহায়তা না করলে মনজিলে মাকসাদ স্পর্শ করা সম্ভব নয়। সাময়িকের জন্য কাউকে ঠেকিয়ে রাখা যায়, কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়—কিন্তু সবাইকে সব সময়ের জন্য ভূগোল বোঝানো সম্ভব নয়। আপনার থাকা না থাকায় জোয়ার-ভাটায় প্রভাব পড়ে না।
কতিপয় মানুষ ক্ষমতা, চেয়ার কিংবা পদ-পদবি পেলে এমন আচরণ করতে শুরু করে, যা দেখে মনে হয়—এখানে সে চিরকাল বিচরণ করবে। অথচ মানুষ বাঁচেই ক্ষণকাল। স্বল্প আয়ুতে বিশাল গল্প করার সময় নাই। যেখানেই থাকি, যেন মনুষ্যত্বের মান রাখি। ‘দেখিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দেওয়ার আগেই যাতে নিজে ছবি হয়ে না যাই।
যেখানে এক সেকেন্ডের ভরসা নাই, সেখানে মানুষ ঠকিয়ে, ব্যথা দিয়ে কিংবা কাউকে কাঁদিয়ে অর্জন কী? কাউকে ঠেকিয়ে রাখার কিংবা ঠকানোর পরের ধাপ মানুষ মনে রাখে না। নিজেকেও যে ঠকতে হবে, কোথাও গিয়ে ঠেকতে হবে—এই বিশ্বাসও মানুষের থাকা উচিত।
সুদ-ঘুষ খেয়ে, দুর্নীতি-অসততা করে কিংবা নীতিহীন হয়ে কতদূর যাওয়া যায়? একটা মানুষ কত খেতে পারে? কিংবা কার কতটুকু লাগে? অনেকেই লোভী। এই লোভই অসুখী হওয়ার প্রধান কারণ। শাস্ত্র মানুষকে অসৎ হতে বারণ করার পরেও মানুষ পাল্লা দিয়ে নিয়ম ভাঙে। কথায় কথায় বিশ্বাস নষ্ট করে। নিজেকে অনেক কিছু ভেবে দম্ভভরে জমিনে চলে, অহংকারী আচরণ করে এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলে।
দুনিয়ার কবরগুলো দেখে মানুষ শিক্ষা নেয় না। রাজা-বাদশাহের করুণ পরিণতি জেনেও মানুষ নিজেকে বদলায় না। অথচ সামনে সুদিন অপেক্ষায় ছিল। তবুও মানুষ ভুল পথে পা বাড়ায়। অনেকেই ‘ডেভিল জিনিয়াসে’র ভূমিকায় থাকে।
নিজে নিজেকে অতি সামান্য ভাবুন। আপনি যে বড়—সেটা যেন অন্যরা ভাবতে পারে, কাজ ও কথার দ্বারা,আচরণ ও স্বভাব দ্বারা এমন ক্ষেত্র তৈরি করুন। মানুষের জন্য কাজ করুন এবং মানুষকে ভালোবাসুন। নিজেকে অনন্য স্তরের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সমাজে অপাংক্তেয় হবেন না। সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ হওয়া যায়।
ভাব দেখালে, দাম বাড়ালে প্রয়োজনের প্রিয়জন হবেন—কিন্তু কারো মনের নাগাল পাবেন না। আমি ছাড়াও যে দুনিয়ায় সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে, সেখানে নিজেকে বিশাল কিছু ভেবে বসে থাকা—নিরেটভাবে আহাম্মকি।
ভালোবাসার পরেই ভালোবাসা পাবেন। জীবনে কতদূর যাবেন, তা মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপন দ্বারা নির্ধারিত হবে। যে যত জটিল হবে, সে তত বাতিল হবে—মোটাদাগে, দুনিয়া এই সহজরীতি অনুসরণ করে চলে।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।