জীবনকে ভালোবাসা যখন স্বদেশকে ভালোবাসায় প্রসারিত হয়- ড. মুহাম্মদ ইদ্রিছ ভূইয়া

205

বাংলাদেশ। এই দেশের মাটিতে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি। আবাস নির্মাণ করেছি। একে অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। এসব করেছি অনেক প্রতিকূল অবস্থা ও পরিস্থিতির মধ্যে। আমরা এতোসব অচলাবস্থার মধ্যে শুধু বেঁচেই থাকিনি, অনেক উন্নতি করেছি। তাই প্রতিটি নাগরিক গৌরব বোধ করতে পারে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরে।

আমাদের যারা পূর্বসূরি যারা এই দেশ গঠনে যুগে যুগে আত্মাহুতি দিয়েছেন, বিশেষ করে যারা বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধীতা করে লাঞ্ছিত হয়েছেন এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা নিঃশেষে প্রাণ দিয়েছেন, যারা অনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন বাংলাদেশক এ পর্যন্ত আনতে, তারা সকলেই আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের বিশ্বাস ও চেতনার ধারাবাহিকতায় আমাদের ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে হবে। আমাদের কাজ চলতে থাকবে একটি ন্যায্য ও ন্যায়পরায়ণ পরিকল্পিত সমাজ গড়তে। যে সমাজে কিশোর বয়সের একটি ছেলে বড় হতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করবে। এক সময়ে পরিবেশ পরিস্থিতি থমকে দাড়াবে, তখন সমাজই সঠিক সিদ্ধান্ত দেবে বড় হয়ে সে কী হবে। যে সমাজ হবে স্বচ্ছ, যেখানে বর্ণ, গোত্র, ধর্ম নিয়ে বিরোধ থাকবে না। যেখানে আমাদের জাতীয় সুখ-সমৃদ্ধি জীবনের প্রশান্তি হবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমাদের ভিত্তি হবে হিংসা, ঘৃণা, মিথ্যাচার পরিহার। ক্ষমতা প্রদর্শনের পরিবর্তে দায়িত্ববোধের পরিচয়। আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবো। আমাদের চিন্তা-চেতনা সর্বোচ্চে স্থান পাবে। জীবনকে ভালোবাসা তখন আমাদের স্বদেশকে ভালোবাসায় প্রসারিত করবে । তখন আর কোন খাদ থাকবে না, মানুষ হিসাবে অনাবিল আদর্শবাদ এক মহিমান্বিত রূপ ধারণ করতে।

দিনে দিনে আমাদের নিরাপত্তা বলয় ক্রমশ দৃঢ় ও মজবুত হবে। অসহায় ও বয়স্কদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভাগ্য পরিবর্তনে বয়োজ্যেষ্ঠদের উত্থান-পতন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে বয়স্করা যেন হাসি আনন্দে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা প্রশান্তি নিয়ে জীবনের শেষ কটা দিন যাতে অতিবাহিত করে যেতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের এক সময়কার শক্তিশালী সামাজিক বন্ধনকে অবক্ষয়জনিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করে, আবারো দৃঢ় করতে হবে, যাতে জীবনের মূল্যবোধ জীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে থাকে, আমরা সকল বাংলাদেশী মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারি। যেখানে থাকবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে উন্নত শহরগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা।ধর্ম পালন, চিত্ত বিনোদনের জন্য উন্নত পরিবেশ।, বয়স্করা তারুণ্য মতো দুশ্চিন্তামুক্ত ফুরফুরে মেজাজে থাকতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না; আমাদের মূলের টান প্রকৃতি আর মাটি, যেখানে আমাদের ফিরে যেতে হবে হয়তো বা আজকেই বা আগামীতে অন্য যে কোনো সময়।

আমরা তৈরি করবো শ্রম প্রদানে নিয়োজিত যুবকদের নিয়মিত ক্যারিয়ার। ফলে তারা জীবন সম্পর্কে শিক্ষা পাবে। তারা জীবনের স্বপ্ন ও আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তব রূপ দেখতে পাবে। বাংলাদেেেশর যুবকদের যোগ্যতা, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের স্বপ্ন তাদের আগ্রহ বাস্তবায়ন দেখতে পাবে। আমাদের পরিবেশ ও পারিপার্শি¦কতার পরিবর্তন হয়েছে। জাতীয় জীবনের সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সার্বিক পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকে নাগরিক জীবনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে নতুন কৌশল নিতে হবে। আমাদের ভালোবাসা ছড়াতে হবে সর্ব ক্ষেত্রে, এইডস-এর জীবাণু নয়। আমাদের হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের অনুভব করার শক্তি অর্জন করতে হবে। আমাদের থাকতে হবে আত্মার সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ রাখার ক্ষমতা এবং অন্যের কষ্ট বা সুখ নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারার ক্ষমতা। এমনকি সহানুভূতিতেও থাকবে সমতা।

সুষ্ঠু প্রশাসন চালানোর জন্য বিভিন্ন ধাপ থাকবে, কিন্তু মানুষকে প্রশাসনিক ধাপের নিরিখে ছোট বড় করে মুল্যানের অবকাশ থাকবে না। এইসব ক্ষেত্রে পদমর্যাদা দিয়ে মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি ঠিক নয় বলেই আমার বিবেচনা করব।

আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক। জাতীয় বিষয়ে আমরা বিতর্ক করবো এটা স্বাভাবিক। আলোচনা সমালোচনা হবে উন্নতির চিন্তা মাথায় রেখে। আলোচনা বিতর্ক শেষে আবার এক জায়গায় ফিরে আসবো এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিতর্ক করলাম বলে আর কথা হবে না মুখ দেখাদেখি হবে না, এটা অস্বাভাবিক। যেটা আমার দেশে রাজনীতির শীর্ষ নেতাদের চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য। যাদের মধ্যে এটুকু বদান্যতা বা মনের প্রসারতা নেই, তাদের দিয়ে অদাচিত স্বৈরাচারী শাসন চলতে পারে, গণতান্ত্রিক রাজনীতি চলে না। এসব বিষয়ে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ তাদের দায়িত্ব বেশি। আমাদের বর্তমান রাজনীতির পথে পথে অলক্ষ্মী আর সংঘর্ষ। নতুন প্রজন্মের জন্য কোনো দিকনির্দেশনা বা জীবনবোধ নেই এতে।

সব সমাজে একদল লোক থাকে যারা প্রায় সব কথাই খারাপ ভঙ্গিমায় বলেন। তারা নেতিবাচক অবস্থায় কথা বলে মজা পান। তারা অন্যের ভালো কাজের প্রশংসা দূরে থাক নামই শুনতে পারেন না। কিন্তু ভুলের নিন্দায় মুখর থাকেন। এই ধরনের মানুষ সংসারে, কর্মস্থলে, রাজনীতিতে এবং সবখানে সমস্যা তৈরি করে বিপদ ডেকে আনেন। আমরা এদের থেকে দুরে থাকবো

কোন এক সেমিনারে সাবেক এক অর্থ সচিবকে বলতে শুনেছি এ দেশে গরিবরা গরিবকে শোষণ করে। অবসর গিয়ে তিনিই বুদ্ধিজীবী হিসেবে টকশোতে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে দরিদ্রদের উন্নতির বিষয়ে ক্ষমতায় থাকা তখনকার তার অবস্থান থেকে সরে গিয়ে, আসল কথাটা চাকরি ছাড়ার পর বলতে। চাকুরী থাকতে এক রকম ছেড়ে আসলে অন্যরকম। ক্ষমতা, মোহ ও সুবিধার স্বার্থের কাছে তাদের তখন বিবেক বা জাতীয় স্বার্থ বলে কিছু ছিল না। কিন্তু অবসরে এরা আবার ‘সেলিব্রেটি’ হিসেবে সমাজের সামনের কাতারে চলে আসেন। এই মোনাফেক লোক গুলিকে নিয়ে জাতি এক জায়গায় দিনের পর দিন ঘুরপাক খেতে থাকে। যতো দ্রুত এসব বন্ধ হবে ততো দ্রুত জাতি মুক্তি পাবে। সরকারি পদের আরাম আয়েশ কি এতোই প্রিয়, আর এতে কি এতোই শান্তি, এতোই মধুর যে, মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে শিকল আর দাসত্বের দামে পদ কিনতে হবে? নতুন প্রজন্মেকে বুঝতে হবে এসব শিকলে জং ধরে গেছে।

রাজনীতির নামে হিংসা, ঘৃণা, মিথ্যাচার ও বিভেদ বিভক্তি পরিহার করতে হবে। ক্ষমতা প্রদর্শনের পরিবর্তে দায়িত্ববোধের রাজনীতি ও জবাবদিহিতা বাস্তবায়ন, মেধাবী গণতন্ত্রমনা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের সুযোগদান, প্রশাসন, রাজনীতি ও ব্যবসা অঙ্গনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। হইচই না করে সব সময়ই নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত রাখতে হবে।

আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশ বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল মাইলফলক। আমাদের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। ধর্মীয় স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ, এর মৌলিক অধিকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের আত্মত্যাগের অঙ্গীকার নিয়ে নীরবে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আছে। সেই অঙ্গীকার রাখতে হবে অনন্তকাল।

আমরা নিরাস হতে চাই না। আমাদের সামনে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ। আমাদের উপলব্ধি না করে উপায় নেই। কাদা পানিতে ডুব দিয়ে বেশিদিন থাকা যাবে না। হয়তো আজ অথবা আগামীকাল আমাদের জন্য সংকটময় হবে। তবু আমরা স্বপ্ন দেখি এ স্বপ্নগাথা আছে বাঙালির অস্তিত্বে। আমরা স্বপ্ন দেখি, কোন না কোন দিন মানুষ জাগ্রত হবে মানুষের বিশ্বাসের মূল্যায়নের উপর।

শেষ করতে চাই আমার পিতা আব্দুর রহমান ভূইয়া (১৯১৬-১৯৭৯) যিনি ১৯৩৫ সালে কলকাতায় গিয়ে বৃটিশ ভারত পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন। যিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যারা ক্ষমতার কলকাঠি নেড়েছেন, চাকুরী করতে গিয়ে খুব কাছে থেকে ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তাদের দেখেছেন। শেষে দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষাক্ত নি:শাষ দেখেছেন। তিলে তিলে অনুভব করেছেন ইংরেজরা ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন অর্থ সম্পদ ভারত থেকে নিয়ে গেছে, এর কি হবে? হিন্দু মুসলমান নেতাদের কাউকে এনিয়ে কিছু বলতে শুনেন নি। দেশ ভাগাভাগি হলে কে কিভাবে আখের গুছাবে এ নিয়ে ব্যস্ততা দেখেছেন । যার পরিণাম ভারত ভাগ হয়ে হিন্দু মুসলিম বিরোধ ছাড়া কেন সুফল বয়ে আনে নাই। শুধু ভারতের পশ্চিম অংশে এবং পূর্ব অংশ নিয়ে মুসলমানদের যে দেশ হচ্ছে সেখানে ভারতের শীর্ষ মুসলমান আলেম ওলেমাগন যারা শরিয়াহ আইনের নিয়ন্ত্রন করতেন তারা আসেন নাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ত প্রায় ৯ বছর আমার পিতা বেচে গেলেন কিন্তু ভারতের আলেম ওলেমা যাদের ভাষনে আলোকিত ছিলেন যৌবনে তারা ভারতেই রয়ে গেল,তাদের মুখে ইসলাম ধর্মের জ্ঞানগর্ভ কথা আর শুনেন নি। শুনতে হয়েছে ধর্ম ব্যাবসায়ীদের কথা।

আমি তার সন্তান হিসেবে দেখে গেলাম, ভারতের ১৪ কোটি মুসলমানদের মধ্যেই ইসলামের সকল শাখা প্রশাখার বিখ্যাত আলেম ওলামাগন রয়ে গেলেন। অথচ পাকিস্তান + বাংলাদেশের ৩৫/৪০ কোটি মুসলমানদের মধ্য ভারতের ঐ আলেমদের অতিক্রম করার মত জ্ঞানী দীনি আলেম নাই। দীনি এলমেদের প্রতি অবহেলা করে মুসলমানদের নেতা দাবীদার হয়েছেন এমন মানুষ যারা ঠিক মত কলেমা জানেন না, নামাজ রোজা করেন না। হিন্দু মুসলমান এক হয়ে বসবাসে বাধা সৃষ্টি করে চলছেন আজো। তাদের আদর্শ হীন, প্রাণহীন এইসব প্রচারের পরিনাম কি ভারত উপ মহাদেশের আপামর জনতার জন্য কল্যান কর হয়েছে ?
আমার মরহুম পিতা রাজনীতি করতেন না, কিন্তু রাজনীতি বুঝতেন না যে তা সঠিক নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তিনি ভীষন খুশি হয়েছিলেন এই অনুভবে যে শেষ পর্যন্ত দেখে গেলেন দ্বিজাতি তত্ত্ব ভুল প্রমাণ হলো।

আমার পিতা শেষ বয়সে তবলীগে যেতেন ভারত থেকে আসা আলেম ওলামার বয়ান শোনার জন্য। তার ফেলে আসা দিন গুলির মধুর স্মৃতি চারনের জন্য। দেওবন্ধ, আলীগড়সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা আলেমেদের জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কথাবার্তা আমাকে শোনাতেন। সহজ সরল জীবন ও ধর্ম বিশ্বাস যেমন ‘খাওয়া দাওয়া, লেবাস বা পোশাক, ঘরবাড়ি, ভ্রমন, বিবাহ-শাদি ইত্যাদির খরচ যদি মাত্রায় রাখা যায়, তবে জীবনের উদ্দেশ্য পুরা করা করে জীবন ও জগত দুনিয়া শান্তিময় করা যায়।’ আমার মরহুম পিতার বিশ্বাসের অন্তর্নিহিত বিশ্লেষণে
জীবনকে ভালোবাসা স্বদেশকে ভালোবাসায় প্রসারিত করতে পারে।

লেখক : “মেসেজ অব ইসলাম’ গ্রন্থের প্রণেতা, আইনজীবী, এডিবি ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক কনসালটেন্ট, গবেষক ও কলামিষ্ট।