সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতারণা: চকচকে ফাঁদের অদৃশ্য কারাগার

99
ছবি- সংগৃহীত
ছবি- সংগৃহীত

সম্প্রতি ফেসবুকে কিছু আকর্ষণীয় ছবির সঙ্গে নজরকাড়া বার্তা ঘুরছে— “আমার বিধবা মাকে বিয়ে দিতে চাই” কিংবা “আমি ডিভোর্সি বলে কি কেউ দায়িত্ব নেবেন না?”—এই ধরনের আবেদনে অনেকেই কৌতূহলী হচ্ছেন। ছবিগুলোর চেহারা ও আবেদন এমনভাবে উপস্থাপিত যে, সাধারণ ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। এসব পোস্টে যোগাযোগ করতে বলা হয় কমেন্ট বক্সে ইমোজি দিয়ে বা হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে।

একদিন এক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি আমাকে একটি ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা, ব্যাপারটা কি সত্যি?” ছবিতে একজন নারী, পরিচয় অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা, বয়স চল্লিশ এবং বিবাহবিচ্ছিন্ন। কিন্তু চেহারায় যেন তরুণ বয়সের কোনো চলচ্চিত্র অভিনেত্রী! তিনি হেসে বললেন, “সুযোগ থাকলে তো আমিই যোগাযোগ করতাম!” সে যাই হোক—

এইসব বিজ্ঞাপন নিঃসন্দেহে মিথ্যা ও প্রতারণামূলক। কখনো এগুলোর পেছনে থাকে সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র, কখনো ব্যক্তিগত কুপ্রবৃত্তির ফাঁদ। প্রবাসীরা এখানে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যবস্তু। একাকিত্ব, আবেগ এবং দূরত্বের সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ এসব ফাঁদে পড়ে যান। ফলে উপার্জনের একটি বড় অংশ অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হয়, বিনষ্ট হয় সময় ও মানসিক শান্তি।

দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো সংসারে অসন্তুষ্ট মধ্যবয়সী পুরুষেরা। তবে এদের অসন্তুষ্ট বলা ভুল হবে—অনেকেই নিজের ব্যক্তিত্ব ও নীতিগত শূন্যতার জন্য এসব ফাঁদে পা রাখেন। ফলে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি নৈতিক ও পারিবারিক স্থিতিও ভেঙে পড়ে। প্রশ্ন থাকে—দোষ কার বেশি? প্রতারকের, না প্রতারণার প্রতি দুর্বল ব্যক্তির?

তবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে আমাদের তরুণেরা। এই বয়সে কৌতূহল ও আবেগ মিলেমিশে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাহারি ভাষা ও লোভনীয় ছবি তাদের অনেকে ধ্বংসের পথে টেনে নিচ্ছে। কেউ কেউ এসব প্রতারণায় ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে সবকিছু হারাচ্ছেন—অর্থ, সম্মান, মানসিক স্থিতি। কেউ কেউ হয়তো একসময় মুখ খোলেন, কিন্তু অধিকাংশই নীরবে ক্ষত বয়ে বেড়ান।

প্রথমেই প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা। সোশ্যাল মিডিয়াতেই “অ্যান্টি-ফ্রড ক্যাম্পেইন” চালু করা যেতে পারে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে অনলাইন নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা বিষয়ে সচেতন করতে হবে। মনে রাখতে হবে—এটি যতই ‘সামাজিক’ হোক, এখানে ‘অসামাজিক’ প্রবণতা অনেক বেশি। কেউ কেউ এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছেন ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে।

সরকারের পক্ষে এটি রোধ করা একেবারেই অসম্ভব নয়। প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ। আইসিটি বিভাগ প্রত্যেক উপজেলায় আইসিটি অফিসারের নেতৃত্বে ১-২ জনের একটি মনিটরিং টিম গঠন করতে পারে। এই টিম অনলাইন প্রতারণা, জুয়া, ভুয়া সম্পর্ক ও নারী কেন্দ্রিক বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট শনাক্ত করে রিপোর্ট করবে এবং প্রয়োজনে সরিয়ে দেবে। প্রতারকদের অর্থদণ্ডের মাধ্যমে এই টিমের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব, রাষ্ট্রের অতিরিক্ত ব্যয় ছাড়াই।

তরুণ প্রজন্ম যতদূর যাবে, দেশটিও সেই পথেই অগ্রসর হবে। তাদের বিপথগামীতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে তা একসময় জাতির জন্য স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখনই সময়—ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে একযোগে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। প্রতারণার চকচকে প্রলোভনে পা না দিয়ে সচেতনতা ও সতর্কতার আলোকবর্তিকা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

শেকড়েই যদি পচন ধরে, তাহলে ডালপালার সতেজতা ধরে রাখা যায় না।

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।