অবহেলা এটা শুধু একটি অনুভূতি নয়, বরং এমন একটি অভিজ্ঞতা যা মানুষের আত্মবিশ্বাস, সম্পর্ক এবং মানসিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। সম্পর্ক যত কাছের হয়, অবহেলা ততবেশী কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে।
অবহেলা এটা শুধু একটি অনুভূতি নয়, বরং এমন একটি অভিজ্ঞতা যা মানুষের আত্মবিশ্বাস, সম্পর্ক এবং মানসিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। অবহেলার যন্ত্রণা অনেক সময় সরাসরি না বুঝলেও, সেটা ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য ভার হয়ে যায় হৃদয়ের ওপর। সম্পর্ক যত কাছের হয়, অবহেলা ততবেশী কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে।
আমরা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অবহেলার মুখোমুখি হয়েছি পরিবারে, বন্ধুত্বে, ভালোবাসায় কিংবা বিশ্বাসে।
আবার কখনো না জেনে, না বুঝে, অমনোযোগী হয় কারো প্রতি অবহেলা করে ফেলেছি। অথচ একটু মনোযোগী হলে বা একটু দায়িত্বশীল হয়তো বদলে দিতে পারত সেই মানুষটির অনুভূতি, জীবন, এমনকি ভবিষ্যতও।
আমরা অনেকেই কখনো কখনো কাছের কিংবা দূরের মানুষের অবহেলার স্বীকারও হয়ে থাকি বা কখনো কখনো নিজেরাও জেনে না জেনে কাউকে অবহেলা করে থাকি।
এই অবহেলায় কখনো আমরা নিজেই অবহেলিত হই, আবার কখনো না জেনে, না বুঝে কাউকে অবহেলা করে কষ্ট দিয়ে ফেলি। অথচ একটু মনোযোগ, একটু যত্নই হয়তো বদলে দিতে পারত সেই মানুষটির অনুভূতি, জীবন, এমনকি ভবিষ্যতও।
এমনি একটা ঘটনা ঘটেছিল, তখন আমার পিতা যখন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার মোহনগঞ্জে চাকরি করতেন। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। মোহনগঞ্জ হতে গৌরীপুর জংশন হয়ে ট্রেন ময়মনসিংহ অথবা চট্টগ্রাম যেত।

আমার নানা শেখ আব্দুল জব্বার ১৯০৯ সালে এন্ট্রাস পাশ করে কুমিল্লার জমিদারি এস্টেটে চাকুরী করতেন । তদানিন্তন ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে কিছু রাজস্ব এলাকা নিয়ে গঠিত একককে পরগনা বলা হতো। এমনি বর্তমানে যেই অঞ্চলটি কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলা, এই অঞ্চলটি ছিল বরদাহাত পরগনার অন্তর্ভুক্ত। গোমতী নদীর তীরে নান্দনিক পরিবেশে বরদাহাত পরগনার প্রধান রাজশ্ব ভবন ছিল দ্বেবিদুয়ার বাজারে, যার কর্তাব্যক্তি ছিলেন নানা। তিনি ঋণ শালিসি বোর্ড ও জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক নামীদামী নেতা এই এলাকায় আসলে তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। “জব্বার শেখ’ ছিলেন দেবিদ্বারের এমনি একজন প্রবাদ প্রতিম মানুষ এবং সংবেদনশীল ব্যক্তিত্ব।
আমার পিতা যখন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার মোহনগঞ্জ সার্কেলের ছিলেন তখন নানা মোহনগঞ্জ বেড়াতে এসেছিলেন। তখন আমি মোহনগঞ্জ পাইলট স্কুলে নবম শ্রেনীতে পড়ি। আমি সেই সময় গৌরীপুর জংশনে গিয়ে নানাকে চট্টগ্রাম অভিমুখী মেইল ট্টেনে নিরাপদে তুলে দিতে গৌরীপুর এসেছিলাম, তখন ভোর রাত। আমি নানার হাতে টিকেট দিবার সময় আমি যেই টিকিট করে মোহনগঞ্জ থেকে গৌরীপুর গিয়েছিলাম, অসাবধানতা বশত তার হাতে কুমিল্লার টিকিটটি না দিয়ে,মোহনগঞ্জ থেকে গৌরীপুর যাওয়ার সেই ব্যবহৃত টিকেটটি দিয়েছিলাম। তার জন্য গৌরীপুরের ষ্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে নেয়া কুমিল্লার টিকিটটি আমার পকেটে অসাবধানতা বশত রয়ে গিয়েছিল। আমি যখন নানাকে কুমিল্লা অভিমুখী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনে তুলে দিয়ে গৌরীপুর থেকে আমাদের বাসা মোহনগঞ্জ ফিরছি, তখন আমার পকেটে নানার জন্য কুমিল্লা অভিমুখী যে টিকিটটি গৌরীপুর রেল স্টেশন থেকে কিনেছিলাম তা আমার প্যান্টের পকেটে দেখে এতটাই হতভম্ভ এবং এতটাই কষ্ট পেয়েছিলাম যা আজ ৬০ বছর পড়ও মন থেকে মুছতে চায় না । এই ভুলটির কথা চিন্তা করতে ভাবতে ভাবতে এতটাই কষ্ট পেয়েছিলাম যে নানা কুমিল্লা স্টেশন নেমে যখন টিকেট কালেক্টর হাতে আমার ব্যবহৃত টিকিটটি দিবেন তখন টিকেট কালেক্টরের কাছে কতইনা লজ্জা পাবেন, কতইনা না লাঞ্ছনা পাবেন। এর পরিণাম নানার জন্য কত না দুঃখজনক হবে, কতনা ব্যদনা দায়ক হবে। ঐ সময় কোন মোবাইল ফোন ছিল না, তারের মাধ্যমে টেলিফোন ব্যবস্থাটিও ছিলনা (শুধু টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ছিল সাংকেতিক শব্দ বুঝার জন্য)। চলন্ত ট্রেনে নানাকে ঘটনাটি না জানাতে বা কুমিল্লা ষ্টেশন মাষ্টারকে কোন অগ্রীম প্রতিকারের ব্যবস্থা করার সংবাদ পৌঁছাতে।
এইভাবে দু:চিন্তায় থাকতে থাকতে কয়েকদিন পর যখন কুমিল্লা থেকে নানার চিঠি এলো, এই বিব্রত বিব্রতকর অবস্থাটি নানা চিঠি লিখে আব্বাকে জানালেন, সেদিন আব্বা আমাকে ডেকে আমার মানষিক অবস্থা বুঝে বলেছিলেন পুরাতন ব্যবহৃত টিকিট পকেটে রাখতে নেই। এইটি সংশ্লিষ্ট ষ্টেশনের টিকিট কালেক্টরের হাতে দিয়ে দেয়া একজন যাত্রীর দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আমি অমান্য করায় এই সমস্যাটি হয়েছে। যা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ বটে। এই অপরাধ বোধ আজো নির্জনে নিবৃত্তে আমাকে কাদাঁয়। তাই বলি অবহেলা একটি নীরব ক্ষরণ যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না এটি এমন এক যন্ত্রণা, যা কখনো শব্দে প্রকাশ পায় না, বরং নিরবতার মধ্যেই তীব্র হয়ে ওঠে।
— বীরমুক্তিযোদ্ধা ড.মুহম্মদ ইদ্রিছ ভূইয়া