সংসারেই প্রথম ভাঙে মানুষটা-প্রতিষ্ঠানে ভদ্র বস মানেই অসহায় বস-রাষ্ট্রীয় পরিসরে নরমতা দুর্বলতা হিসেবেই ধরা পড়ে-ভদ্রতা—হ্যাঁ, তবে বাছ-বিচার করে
।।এক।।
সংসারেই প্রথম ভাঙে মানুষটা-
সংসারের আপনি কর্তা? স্বভাবে নরম? যা বলা হয়, তাই শুনে ফেলেন? কিংবা কিছুতেই “না” বলতে পারেন না? তাহলে শুনে রাখুন- আপনাকে ভর্তা বানিয়ে খাবে! মোটকথা, আপনার সামান্যতম মূল্যায়নও থাকবে না। আলু-করলার সঙ্গে যেমন আচরণ করা হয়, আপনার সঙ্গেও তাই করা হবে। সম্মান তো দূরের কথা, সবকিছু মুখ বুঁজে সহ্য করেও কারো মন পাবেন না।
ওরে! এই সংসারে ভদ্রতা মানেই দুর্বলতা।
অথচ চটাং চটাং কথা বলতে পারলে, মুখের ওপর “না” বলতে জানলে অন্তত কিছুটা সমীহ পেতেন।
।।দুই।।
প্রতিষ্ঠানে ভদ্র বস মানেই অসহায় বস
চলুন এবার অফিসে। আপনি বস? কিন্তু কড়া ভাষায় কথা বলতে পারেন না? কাউকে নির্দেশ দিয়ে কাজ আদায় করতে দ্বিধা হয়? যার তার সঙ্গে চোখ উল্টে ধমক দিতে পারেন না? মুখের ওপর আব্দার ফিরিয়ে দিতে পারেন না?
তাহলে আপনি মুশকিলে পড়েছেন! আপনাকে ‘ভেড়া’ ভেবে নেওয়া হবে।
আপনার বিরুদ্ধে দল পাকানো হবে।
সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে কুৎসা রটানো হবে।
ভালো মানুষ হওয়াটা যথেষ্ট নয়—একজন প্রশাসক হিসেবে দৃঢ় না হলে আপনি প্রতিষ্ঠান ডুবাচ্ছেন। এই সমাজ এখনও এমন নয় যে ভালোবাসার বিনিময়ে কর্তৃত্ব মেনে নেয়। এখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত—উভয়েই সুযোগ খোঁজে।
আপনি কাউকে ঠেকালে, সে-ই আপনার শত্রু হয়ে যাবে। আপনি কাউকে বাড়তি সুযাগ দিলে, সে-ও আপনাকে অপব্যবহার করবে। তাই দায়িত্ব পালন করুন—কাউকে খুশি রাখতে গিয়ে নিজের অবস্থান নষ্ট করবেন না।
।।তিন।।
রাষ্ট্রীয় পরিসরে নরমতা দুর্বলতা হিসেবেই ধরা পড়ে
চলুন এবার রাষ্ট্রপর্যায়ে। আপনি যদি নরম কথা বলে জনতার মন জয়ের স্বপ্ন দেখেন, তবে দুঃখিত, আপনি সরল। আর সরল রাজনীতি করলে জটিল জনতা আপনাকে নাচিয়ে ছাড়বে। আঠারো কোটি মানুষের দেশে আঠারো হাজার জন যদি খ্যাপা হয়, পুরো জাতির শান্তি তছনছ হয়ে যাবে।
আপনি যত নরম হবেন, তারা তত চড়া হবে। শুধু সরকার নয়, গোটা রাষ্ট্রকেই তারা ভোগাবে। তাই বলি—কড়া হোন, সব এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।
শাসক নরম হলে এই জাতি সেই শাসকের মাথায় লবণ রেখে বরই খায়। নানাবিধ অবরোধ, দাবি, বিশৃঙ্খলা—সব বাড়তে থাকে। দায়িত্ব অবহেলাকারীদের ঘাড় ধরে বের করে দিন। দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন। অপরাধীদের জেলে পুরে দিন। তাহলেই বাকিরা আপসে শায়েস্তা হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে ঝিকে মেরে বউকে শেখাতে হয়।
।।চার।।
ভদ্রতা—হ্যাঁ, তবে বাছ-বিচার করে
ভদ্রতা নিঃসন্দেহে একটি মহৎ গুণ। কিন্তু কার সামনে আপনি ভদ্রতা দেখাচ্ছেন- এটা বিবেচনা জরুরি। অমানুষদের সামনে মানুষ সাজলে তারা আপনাকে গরু ভেবে বসবে। গাঁধা ভেবে কাঁধে চড়বে। ঘোড়া ভেবে আঘাত করবে। তাই একটু কঠোর হোন।
এটা আপনার ভাবনার দুনিয়া না। এখানে যারা বিনয়ী, অন্যরা তাদের মাথাকে পদাঘাত করে। যারা দলান্ধে স্বার্থপর এবং আচরণে অমানুষ তাদের সামনে নম্রতা মানে নিজের ওপর অন্যায় চাপিয়ে নেওয়া।
ভালোর পক্ষে দাঁড়াতে হলে কঠোরতার সঙ্গেই সাহস চাই। ভালো তো হবেনই, কিন্তু খারাপের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভালোত্ব রক্ষার দায়টাও আপনারই। না হলে সেই ‘ভদ্রতা’ একসময় গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়।
আজকের সমাজে ভালোমানুষি মুখের বুলি দিয়ে টিকে থাকা যায় না। ভদ্রতা হোক বুদ্ধির অংশ, দুর্বলতার নয়। সৎ থাকুন, মানবিক থাকুন, কিন্তু হুঁশিয়ার থাকুন—না হলে এই সমাজ, এই প্রতিষ্ঠান, এই রাষ্ট্র—সব মিলেই আপনাকে একদিন চেপে ধরবে। নিজেকে বাঁচাতে হলে শুধু ভালো নয়, ভালোর পক্ষে কঠিন হতে শিখুন।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।