পরিচয়ে পরিচয়ে প্রেম—লক্ষণ ভালো না। মেয়েটার চাকরি আছে এবং বয়স সামনে ঝুঁকেছে। এবার বর মিলছে না। কেননা পরিচয় তো আরেকটা পরিচয় চায়! ছেলেটা শেষমেশ চাকরি জুটিয়ে হাটে উঠেছে। কিন্তু বিক্রি হওয়ার জন্য যে উর্বর খামার দরকার, তা মিলছে না। চাহিদা বেড়েই চলেছে যে!
চাকরির সাথে চাকরির কিংবা পদের সাথে পদবীর যে বিবাহকার্য সম্পাদিত হয়েছে, তারা মিলেমিশে কেমন আছে? বেকার মেয়েটির একটি সম্বন্ধতেও যারা ‘হ্যাঁ’ বলেনি, তারাই মেয়েটি চাকরি পেয়েছে শুনে ছুটে এসে বউ করতে পীড়াপীড়ি শুরু করে! অথচ সমাজের চোখে রূপে পিছিয়ে থাকা মেয়েটির চোখের পানির এই সেদিনও সামান্যও মূল্য ছিল না। ছেলেটির পরিচয় জোটেনি বলে যারা কন্যাদানে প্রবল অনাগ্রহ দেখিয়েছিল, তারাই এখন সভাসদ এগিয়ে এসেছে। রাজি না হলেই বরং অনশন অবস্থা! অথচ কত ভালো মরে গেছে মাঝপথে। হয়ত এখনো দাফন হয়নি বরং দগদগে ক্ষত জ্যান্ত আছে!
রাষ্ট্রীয় পরিচয় জুটে যাওয়ার আশীর্বাদে এলাকা কাঁপিয়ে, দাপিয়ে অনেকটা মহারণ—সানাই দীর্ঘক্ষণ বাজলো বটে। কে, কার মন পেলো তা জানিনে! বিয়েটা কী বর-কনেতে হলে, নাকি চাকরি-চাকরির সাথে মালাবদল ঘটলো— সে এক লম্বা ইতিহাস! তবে পরিচয়ের সাথে পরিচয়ের যে বিবাহ, সেখানে মানুষ মানুষের সাথে দেখা হয় খুব সামান্যই। খ্যাতি-পরিচিতির ভারবাহী হয়ে মনুষ্যত্বের পরিচয় খুঁজলে, হয়তো কিছুটা পাওয়া যায়!
বিপত্তিও ঘটে বটে। মেয়েটার চাকরি আছে এবং বয়স সামনে ঝুঁকেছে। এবার বর মিলছে না। কেননা পরিচয় তো আরেকটা পরিচয় চায়! ছেলেটা শেষমেশ চাকরি জুটিয়ে হাটে উঠেছে। কিন্তু বিক্রি হওয়ার জন্য যে উর্বর খামার দরকার, তা মিলছে না। চাহিদা বেড়েই চলেছে যে! পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে রাত্রি নেমেছে, তবুও বাতি জ্বলছে না। সবকিছু দরকার, তবে বেশি দরকার সাদা চামড়া! যার চেহারায় লাইট মেরেও দাঁত ছাড়া কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না, তার পাশেও লাগবে চাঁদের বাতি। তওবা! কারো সুরত নিয়ে না মাতি। এতে পাপ হয়। মাফ করে মওলা।
এই যে চেয়ারে চেয়ারে বিয়ে, পরিচয়ে পরিচয়ে প্রেম—লক্ষণ ভালো না। কার সময় কখন মুক্ত হয়, আর কে কার পুকুরে সাঁতরায়—তা কেউ জানে না। শুধু চেহারা দেখে বিয়ে করা কিংবা কেবল চাকরি দেখে ঝাঁপ দেওয়া—অনেককেই ডুবতে হয়। যখন কিছুই ছিল না, তখন যারা থাকে—ভবিষ্যতে তারাই কেবল আপন হয়। বাকিরা স্বার্থ বুঝতে আসে। প্রয়োজনে হাত ধরে হাঁটে। প্রয়োজনে শেষ তো নিরুদ্দেশ। যারা লোভে কাতর হয়ে অকাতরে সবকিছু বিলায়, তারা অনেকেই পরিণয়ের পরিণতি দুর্বিষহ দশা বছর কয়েক পরেই টের পায়। যখন তওবা করে, তখন আর জীবনের মাফ করার সাধ্য থাকে না। আমার তওবা কবুল হয়েছে?
সম্পর্কের ভিত্তিতে মনের মানুষ খোঁজ দরকার। সে চির অচেনা হোক তবুও যেন স্বার্থের হাটে না দেখা না হয়। পয়সাও কখনো কখনো মানসিক বোঝায় পরিণত হয়। শুধু চাকরি, মাস শেষে বেতন—এই লোভে যারা সামনে বাড়ে, তাদের সুখ অতীতে পড়ে রয়। বয়স বাড়ছে— সবকিছু মাথায় রেখে বহুকিছুতে ছাড় দিতে হয়। পুরুষকে চাকরি করতেই হবে কিংবা নারীকে সুন্দরী হতেই হবে—জীবনের ভুল পথ। যার রিজিক, সে বয়ে চলে—তবে হয়তো অন্য কারো মাধ্যমে আসে। সৌন্দর্য মানে স্বতঃস্ফূর্ততা। রঙচঙে যারা রূপ খোঁজে, এদের বেশিরভাগ ধরা খাওয়া পাবলিক! এখন আহা-উঁহু পর্যন্ত করতে পারে না। লোকে কী বলবে! কিছুটা উঁচু সমাজে তারা হাঁটে যে!
কে কীভাবে ভালো থাকবে, মানুষ তা নির্ধারণ করতে পারে না। মানুষ মানুষকে নির্বাচন করতে পারে, তবে সুখ অ-গ্রন্থিত। অদৃশ্যমার শক্তি সুখকে সুসংহত করেন। মানসিক পরিতৃপ্তির চেয়ে বড় কোনো অর্জন নাই। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিরুৎসাহিত করার মতো ব্যাপার নয়, তবে তা যাতে বাস্তবতাকে অতিক্রান্ত না করে। যে ফল পরিপক্ব হওয়ার পরেও আরও মিষ্টির আশায় গাছে ঝুলিয়ে রাখি—পাকলে খাবো ভেবে, তা বাঁদুরেও ভক্ষণ করে যেতে পারে। কাজেই বার্তা পরিষ্কার—মানুষের জন্য সামগ্রিকভাবে যাতে মানুষ অপেক্ষায় থাকে, সেই আয়োজন হোক।
পদের পরিচয় মানুষের মুখ্য নয়, বরং গৌণ পরিচয়। চাকুরে দম্ভ করতে পারে না। সে তো গোলাম, পরাধীন। উচ্চ বেতন ভোগের ব্যাপ্তিকে প্রশস্ত করতে পারে, অনেকভাবে স্থুল সুখকে নিশ্চিত করতে তবে সুক্ষ্ম সুখ অবধারিত কিংবা অবারিত করে না। জীবনের জন্য একজন মানুষ খুঁজে বের করা জরুরি, যার কাছে আত্মিক প্রশান্তির ওষুধ আছে। কেবল ব্যস্ততা, প্রিয়জনের জন্য সময় না থাকা কিংবা সংসার-সন্তান উপেক্ষায় রাখা—পরিণাম শুভ কিংবা সুখকর হবে না। সামর্থ্য সামান্য থাকুক, তবুও সুখ-সমৃদ্ধিতে মনের আঙিন ভরে থাকুক। জীবনের সুখ-দুঃখের রঙ একেক বয়সে একেক রকম।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।