একজন মানুষকে বারবার অনুরোধ করতে হলে, নিজের আত্মসম্মান বারবার গিলে ফেলতে হয়-জীবনে যত কম কথা বলে কাজ সেরে ফেলা যায়, ততই ভালো
কেউ কেউ আছেন যারা একবার যা বলেন, তা দ্বিতীয়বার বলেন না। অহেতুক কারো কাছে অনুরোধ করা, সুপারিশ করা কিংবা অনবরত কিছু চেয়ে যাওয়া—এসব থেকে তারা দূরে থাকেন। তারা জানেন, আত্মমর্যাদা রক্ষার চেয়ে বড় কিছু নেই। জীবনের কাছ থেকেও তারা সম্মান নিয়ে বাঁচতে চান, করুণা নিয়ে নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এমন সংযত মানুষেরা জীবন থেকে বঞ্চিতও হন না।
একজন মানুষকে বারবার অনুরোধ করতে হলে, নিজের আত্মসম্মান বারবার গিলে ফেলতে হয়। আবার ফোন না ধরলে একের পর এক কল দেওয়া, কোনোরকম সংকেত ছাড়াই বারবার মনে করিয়ে দেওয়া—এসব আচরণ আত্মমর্যাদার পরিপন্থী। আমাদের উচিত এককথার মানুষ হওয়া। অবশ্যই একরোখা নয়, বরং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা ও সংবেদনশীল হওয়া।
জীবনে যত কম কথা বলে কাজ সেরে ফেলা যায়, ততই ভালো। কারণ অনেক কথার ভেতর সারকথা থাকে সামান্য। যে মানুষ বুঝতে চায়, সে এক কথাতেই বুঝে নেবে। আর যে বুঝবে না, তাকে দিনের পর দিন বোঝালেও সে শুনবে না। কথার মধ্যে থাকে বুদ্ধির ছায়া, আর সংযত বাক্যেই লুকিয়ে থাকে মন ও মস্তিষ্কের পরিচয়।
শতবার অনুরোধ করতে হলে নিজেকে ছোট করে ফেলতে হয়। একসময় সম্পর্কের ভারসাম্যও হারিয়ে যায়। কাজের ক্ষেত্রে হোক বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে—মাপা কথা, সময়মতো বলা কথা, পরিমিত কথা—সবচেয়ে কার্যকর। পাঁচ কথার জায়গায় পঁচিশ কথা প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু পাঁচশো কথা অনর্থক বাড়াবাড়ি। কখনো কথা মনের দুয়ার খুলে দেয়, আবার কখনো সেই কথাই বন্ধ করে দেয় মনের দরজা। তাই বাক্যের ব্যবহার হতে হবে সুসংহত, সচেতন এবং মার্জিত।
প্রশ্ন হলো, বেশি কথা বলা মানুষ কি আদৌ কারো ভালো লাগে? যেটা আমি নিজে সহ্য করতে পারি না, সেটাই কি অন্যরা সহজে মেনে নেবে? তাই মানুষের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য নৈতিক মানদণ্ড হলো—নিজের অভিজ্ঞতা। আমি যেমন আচরণ চাই, তেমনি আচরণ আমার ভেতরও থাকতে হবে। বুঝেও না বোঝার ভান করলে সময় হয়তো চলে যাবে, কিন্তু মানসিক দাগ থেকে যাবে দীর্ঘকাল।
কাজের কথাই বলি—হোক তা শতবার। কিন্তু অনর্থক কথার ভিড় মানেই সময় ও শক্তির অপচয়। চাই না কেউ আমাকে ‘বাচাল’ বলে জানুক। চাই, আমার কথায় দায়িত্ব থাকুক, আমার নীরবতায় শ্রদ্ধা থাকুক।
আধুনিক সময়ের তথ্যবিকৃত ও কৃত্রিম সম্পর্কের জগতে এককথার মানুষ হয়ে ওঠা সহজ নয়। তবু যারা এই আত্মমর্যাদার পথ ধরে হাঁটে, তারা হয়তো বেশি পাবেন না, তবে যা পাবেন তা সম্মান দিয়ে ঘেরা থাকবে। কম কথা, পরিষ্কার কথা, এবং প্রয়োজনমাফিক কথা—এই তিনেই আত্মপরিচয়ের সৌন্দর্য লুকানো।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।