ন্যায় বিচার হলো জগতের প্রাণ। যা বাস্তবায়নে আইনজীবীদের কমিটমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনজীবীরা শুরুতেই ফৌজদারি অপরাধের শুরুটা জানতে পারেন। জানতে পারেন তার মোয়াক্কেলের দোষ,অপরাধ, মন্দস্বভাব; খুঁত, ত্রুটি ইত্যাদি সম্পর্কে। তেমনই দেওয়ানী মোকদ্দমায় তাদের মোয়াক্কেলের অধিকার, দাবি বা পাওনা সম্পর্কেও শুরু থেকে সঠিক ও নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে জানতে পারেন।
যেহেতু বিগত দিনে ক্রমবর্ধমান মামলার চাপ’ মোকাবেলা সম্পর্কে যেন কারো কিছু আন্তরিক আগ্রহ ছিল না। আইন অঙ্গনে এসে সারা জীবন কাটিয়ে কত বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বড় বড় বাহাস করে গেলেন। কিন্তু আজো কোন বাস্তব পথনির্দেশনা পেল না আইন অঙ্গন।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ নিয়ে লেখা বাড়াতে চাই না । খৃষ্টের জন্মের ১৫০০ খৃষ্টাব্দ পূর্বে হিন্দু শাসন আমলে বিচার ব্যবস্থা ছিল রাজতন্ত্রের সাথে অঙ্গীভূত। মুসলমান আমলে ১১০০ খৃষ্টাব্দের পরবর্তী সুলতানী ও মুগল আমলে একটি আইনি কাঠামোর সূচনা হয়। মানুষের বিরোধ পূর্ণ বিষয়গুলো ইসলামি আইনের নীতি অনুসারে ফয়সালা করা হতো। মুফতি, পন্ডিত এবং কাজীদের সমন্বয়ে পরিশালীত আদালত কাঠামো পরিলক্ষিত হয়। কাজী- উল- কুজ্জাত ( প্রধান কাজী) রাজস্ব বিষয়ক ছাড়া অন্যন্য মামলার বিচার করতেন আর রাজস্ব বিষয়ক বিচার করতেন মুনসেফ।
ভারতবর্ষে ইংরেজ ঔপনিবেশের শুরুতে বৃটেন রাজা প্রথম জর্জ ১৭২৬ সালে ভারতে ইংরেজি আইন প্রয়োগের ভিত্তি স্থাপন করেন। কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে মেয়র আদালত প্রতিষ্ঠা করেন। এই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডে প্রিভি কাউন্সিল আপিল আদালত গঠিত হয়। অতপর এক বিস্তৃত কাহিনী > ধাপে ধাপে দেশীয় রীতিনীতির সাথে ইংরেজি আইনের মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি Common Law System চালু হয়। ১৯৩৫ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন। পরবর্তীতে ১৯৪৭শে ভারত বিভক্তি পূর্ব পাকিস্তান হয় ১৯৫০ প্রিভি কাউন্সিল অধিক্ষেত্র বিলুপ্ত আইন পাশ হয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানে একটি নুতন সংবিধান জারি করা হয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত আইন ও বিচার কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতপর বাংলাদেশে ১৯৭১ Law Continuece Order জারি করা হয় “যেই লাউ সেই কদু’ । ফলে সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় “ক্রমবর্ধমান মামলার চাপে বাংলাদেশ “
মানুষের সারাজীবন জুড়েই ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সমষ্টিগত লেনদেন বা দেনা-পাওনার সম্পর্ক সমস্যা জরিয়ে থাকে। জীবনযাপন সংসার সমাজে দেনা-পাওনার বাইরে কেউ থাকতে পারে না।
যদি কেউ ইচ্ছা করে ধার-দেনার মতো কোনো কাজে নাও জড়ায়, তবুও তার ওপর উত্তরাধিকার সুত্রে নানা কারনে এসব বিষয় এসে যায়।
তাই দ্রুত ও সহজভাবে আইনের বিধানমতে নিস্পত্তি হওয়া আবশ্যক।
মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে গেলে লক্ষ লক্ষ মামলার জটে জর্জরিত বিদ্যমান আইন অঙ্গন টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়বে।
কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে অনেক বলাবলি হলেও যেহেতু আমাদের আইনগুলি মোগলদের থেকে সূচিত হয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসন অতিক্রম করে পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশে এসে থেমেছে।
এবারকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেওয়ানী আইনের মত একটি মুল আইন সংস্কারে নজর দেয়ায় তারা ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে।
দেশের বিচার প্রক্রিয়ায় সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে গতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ২০২৫ সালের দেওয়ানি কার্যবিধি (সংশোধন) অধ্যাদেশে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করেঃ
১। সাক্ষ্যী দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন-
আগে সাক্ষীদের মৌখিকভাবে প্রধান সাক্ষ্য দিতে হতো। এখন তা হলফনামা আকারে জমা দিলেই চলবে। আদালতে সরাসরি হবে, যাতে বিচারক সাক্ষীর আচরণ ও বিশ্বাসযোগ্যতা মূল্যায়ন করতে পারেন।
২। ডিজিটাল সমন ব্যবস্থা-
এখন থেকে মোবাইল ফোন, এসএমএস, ভয়েস কল, হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে সমন পাঠানো যাবে। মামলার আবেদন করার সময় প্রতিপক্ষের মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর এবং ইমেইল যদি থাকে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
৩। ডিক্রির স্বয়ংক্রিয় কার্যকারিতা-
আগে আদালতের রায় (ডিক্রি) কার্যকর করতে আলাদা আবেদন করতে হতো। এখন আর্থিক ডিক্রিসহ কিছু ডিক্রি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে।
৪। একতরফা রায় বাতিলের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা-
আগে একতরফা রায় বাতিল করতে একাধিকবার আবেদন করা যেত। এখন থেকে একজন বাদী বা বিবাদী একবারের বেশি এ ধরনের আবেদন করতে পারবে না।
৫। আপিল প্রক্রিয়ায় সংস্কার-
Order 41 Rule 21 অনুযায়ী, পুনঃশুনানি এখন একবারের বেশি করা যাবে না। এছাড়া Rule 24-এ যে কার্যক্রমগুলো আগে ঐচ্ছিক ছিল, সেগুলো এখন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
৬। মুলতবি সীমিতকরণ-
আগে একেকটি মামলায় ছয়বার পর্যন্ত মুলতবি (adjournment) চাওয়া যেত। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী এখন চারবারের বেশি মুলতবি চাওয়া যাবে না।
আমি এই সংশোধনী আকারে এই পরিবর্তন গুলোকে আদালতের সময় বাচাতে নেতিবাচক হিসাবে আমরা দেখছি। দেখা যাক কতটুকু দ্রুততা আসে মামলার জট নিরসনে।
বীরমুক্তিযোদ্ধা ড.মুহম্মদ ইদ্রিছ ভূইয়া, এডভোকেট সূপ্রীম কোর্ট সাবেক কনসালটেন্ট এডিবি এন্ড ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ। লেখক ও কলামিস্ট
লেখকঃ idris_bhuiyan@yahoo.com