অপ্রয়োজনের দাসত্বে বন্দি মানুষ

0
290

এথেন্সের রাস্তায় খালি পায়ে, ঊর্ধ্বাঙ্গে গামছা বা কাপড় ছাড়াই হাঁটতে হাঁটতে সক্রেটিস গিয়ে দাঁড়ালেন অভিজাত সামগ্রীর দোকানের সামনে। নিস্পলক নেত্রে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন বিক্রেতার দিকে। ক্রেতা আসছে, বিলাসসামগ্রী নিচ্ছে। সক্রেটিস ফিরে এলেন গৃহে।

এভাবে সপ্তাহ গড়িয়ে মাস। বিক্রেতা লক্ষ্য করতেন এথেন্স শহরের উদীয়মান জ্ঞানী সক্রেটিসকে। চোখাচোখিও হয়েছে কয়েকবার। তারপর বিক্রেতাও ব্যস্ত হয়ে পড়তেন বেচাকেনায়, সক্রেটিসও ফিরে আসতেন নিজ কাজে।

একদিন বিক্রেতা জিজ্ঞেস করেই বসলেন, “এখানে রোজ আসেন, দাঁড়িয়ে দেখেন, কিন্তু কখনোই তো কিছু কেনেন না!”

সক্রেটিস রহস্য করে উদাস হয়ে উত্তর করেন, “এগুলো ছাড়াও তো আমার দিব্যি দিন চলছে।”

অপ্রয়োজনীয় উপাদান-সামগ্রী ব্যতীত সক্রেটিসের দিন চললেও আমাদের দিন চলে না। কারো কাছে কিছু দেখলেই, বাজারে নতুন কিছু এলেই আমরা সেসব উন্মাদ হয়ে কিনি। সেগুলো আমাদের দরকার কি না, উপকারে আসবে কি না, বাসায় রাখার জায়গা আছে কি না, কিংবা কেনার সামর্থ্য আছে কি না—সেসব ভাবার ফুরসত পর্যন্ত নাই।

ধার-দেনা করে, অন্যায়-দুর্নীতি করে নিষ্প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনতেই হবে। সে-সব উপাদানে পরিবেশের ক্ষতি হয় কি না, সম্পদের অপব্যবহার হয় কি না কিংবা বাজারদর বাড়ে কি না—তা একটুও বিবেচনায় আনি না।

বিলাসসামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে প্রয়োজন-সমীক্ষায় বাঙালি সবচেয়ে অবিবেচক। ইচ্ছা করেই এরা অভাববোধ বাঁচিয়ে রাখে।

অমুকের গাড়ি আছে তাই আমারও কিনতে হবে, অমুক বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনেছে তাই আমারও সেটা লাগবে, কিংবা অমুকের গহনা-শাড়ি আছে তাই আমারও কাড়ি কাড়ি লাগবে।

মানুষ যদি সামর্থ্য চিন্তা না করে, আবশ্যকতা বিবেচনা না করে এবং প্রয়োজনীয়তার প্রাধান্য নির্ধারণ করতে না পারে, তখন সে অসুখী হবেই।

কারো সাথে তুলনা করে, অসুস্থভাবে সমাজের ট্রেন্ডের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে কিংবা নিজেকে বড় দেখাতে গিয়ে যদি ভোগ-বিলাসে মেতে ওঠে তবে যাদের সত্যিকারের দরকার, তাদের কেউ বঞ্চিত হবে।

সম্পদ কোথাও অসীম না। সম্পদের প্রাচুর্যতা থাকলে স্রষ্টাই সকলকে ধনী করে সৃষ্টি করতেন। জ্ঞানীজন বলে, “আয় বুঝে ব্যয় করো।”

চার চাকার স্বপ্ন অনেকেই দেখে। অথচ সবার যদি চার চাকা হয়, তবে রাস্তা গতি হারাবে, জ্বালানিতে ঘাটতি পড়বে, গ্যারেজের জায়গায় সংকট হবে এবং পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাবে।

অমুক সাহেবের আছে বলে তমুক সাহেবের সেটা সংগ্রহ করতেই হবে—এই প্রতিযোগিতা পুঁজিবাদের অসুস্থতা।

শহরে স্কয়ার ফিটে বাসা ভাড়া করে যারা সেখানে শোকেসে ডিনার সেট সাজিয়ে রাখে—তাদেরকে খুব বেশি বুদ্ধিমান ভাবার সুযোগ নাই!

সঞ্চয়ের সিংহভাগ খরচ করে যারা জমি ক্রয় করে শুধুই থাকার জন্য ইমারত গড়ে—তাদেরকে সুবিবেচক ঠাহর হয় না।

চাষের জমি নষ্ট করে যারা বিস্তৃত জায়গা নিয়ে আলিশান অথচ কৃত্রিমরূপে বসতবাড়ি করে—তাদেরকে প্রকৃতির শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতেই হবে।

“চলছে, অথচ আরও চাই”—এই মনোবৃত্তি মানুষকে ধারাবাহিক দুঃখবোধের উপন্যাসের মতো অসুখী করছে। কখন কোথায় থামতে হবে, সেটা জানতে হবে।

চাহিদার শেষ নাই। কোনোকিছু লাগবেই—এমন বাসনা যখন তীব্র হয়, তখন মস্তিষ্ক সুস্থতা হারায়।

যারা অল্পে তুষ্ট, তাদের জীবনের গল্পগুলোতে সুখের পরশ মেলে। চাওয়ার পরিধি যত বিস্তৃত হবে, অভিযোগ-অনুযোগ যত পাখা মেলবে এবং লোভ যত বাড়বে, জীবনযাপনে অশান্তি ততটাই বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করবে।

যত কম উপকরণ দিয়ে যত বেশি সহজ জীবন নিশ্চিত করা যায়, ততটাই মঙ্গল। অথচ আমাদের জীবন ধীরে ধীরে ইলেকট্রনিকস বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে।

প্রাকৃতিক শোভা হারিয়ে ক্ষতিকর কৃত্রিমতায় সবকিছু জড়িয়ে যাচ্ছে।

ফলশ্রুতিতে, মানুষের আচরণ ধীরে ধীরে রোবটিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হচ্ছে। সরলতা, বিশ্বাস এবং আস্থা মানুষ ভুলতে বসেছে।

ভরসা এখন যন্ত্রকে। শারীরিক শ্রম উপেক্ষা করায় গোটা শরীরটাই রোগের কারখানায় পরিণত হচ্ছে।

প্রকৃতির সাহচর্য বাড়াতে হবে। যান্ত্রিকতার আধিক্য রোধ করতে হবে। জটিলতা এড়িয়ে জীবনকে যত সহজ করা যায়, সেটাই হোক আমাদের প্রচেষ্টা।

উপকরণের প্রাচুর্যতা মানসিক কুটিলতার পথ খোঁজে। কাজেই, কোনো কিছু গ্রহণের আগে ‘Need Analysis’ করা খুব আবশ্যক।

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here