বলছি তোমায়  ইতিহাসের গল্প’ (২য় পর্ব) 

125
মুঘল সামাজ্যের নিদর্শন। ছবি- সংগৃহীত
যেমনি কুতুবউদ্দিন আইবেকের মাধ্যমে ভারতে সুলতানি শাসন শুরু হয়েছিল তেমনি উজবেকিস্তানের নওজাদ তৈমুরী শাসক সুলতান মোহাম্মদের প্রপৌত্র জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের মাধ্যমে  মুঘল শাসন শুরু হয়েছিল ।
মুঘলদের দরবারে ধর্মীয় উদারতা থাকলেও , সুন্নি-শিয়া বিভাজন মুঘল সাম্রাজ্যে সমস্যার সৃষ্টি করে।
মুঘল আমলে ভারতের মুসলমানদের ইতিহাস ছিল এক সমৃদ্ধ ও জটিল অধ্যায়। মুঘল সম্রাটরা ছিলেন মুসলিম এবং তাদের শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সংস্কৃতি, স্থাপত্য, সাহিত্য ও ধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। যদিও এই সময়টিতে মুসলিম শাসকরা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপর সুশাসন করেছেন। সম্রাট আকবরের শাসনামলে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ও ঐক্যের প্রতীক স্বরুপ  “দ্বীন-ই-ইলাহির” নামে একটি নুতন বিশ্বাস ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল।
আওরঙ্গজেবের শাসনামলে সাম্রাজ্যের সীমানা সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হলেও, তার ধর্মীয় কঠোরতা সমালোচিত হয় এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রভাব দুর্বল হতে থাকে।
সমস্থ মুঘল শাসনকাল ব্যাপী ভারতে মুসলিম স্থাপত্য, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছিল। বহু ঐতিহাসিক মসজিদ, প্রাসাদ, এবং সমাধি নির্মিত হয়েছিল যা আজও স্থাপত্যকলার নিদর্শন হিসেবে দন্ডায়মান। আজও ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে।
মুঘল আমলে ভারত উপমহাদেশের মুসলিম দর্শন জগতজুরে  একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এই সময়ে মুসলিম দর্শনে সুফিবাদ, ধর্মতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র, এবং সাহিত্যের বিভিন্ন দিক বিকশিত হয়। সম্রাট আকবরের শাসনামলে দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রবর্তন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, যা বিভিন্ন ধর্মীয় ও দার্শনিক মতবাদের সমন্বয়ের একটি পদক্ষেপ ছিল।
সুফিবাদ মুঘল আমলের একটি প্রভাবশালী ধারা ছিল। সুফিরা স্রষ্টার  প্রেম, মানবতাবাদ এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। সুফিবাদীরা বিভিন্ন খানকাহ ও মাজারের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করতেন।
এই সময় মুসলিম পন্ডিতরা ধর্মতত্ত্ব, দর্শন এবং যুক্তিশাস্ত্রের উপর বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। মোল্লা নিজামুদ্দিন এবং আব্দুল ফজল ছিলেন এই সময়ের উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদ।
মুসলিম আইনশাস্ত্র (ফিকহ) মুঘল আমলে ব্যাপক  বিকশিত হয়েছিল। ফতোয়া-ই-আলমগিরি ছিল এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন বিষয়ক গ্রন্থ।
ফার্সি সাহিত্য মুঘল আমলে সমৃদ্ধ হয়েছিল। সম্রাট বাবর ফার্সি ভাষায় তাঁর আত্মজীবনী “বাবরনামা” লেখেন। আকবরের দরবারের নয়জন রত্নের একজন আবুল ফজল ফার্সি ভাষায় “আইন-ই-আকবরী” রচনা করেন। যা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসন সম্পর্কিত ষোড়শ শতাব্দীর একটি ঐতিহাসিক দলিল। পাশাপাশি মুঘল আমলে চিত্রাঙ্কন, স্থাপত্য এবং সঙ্গীত সহ বিভিন্ন শিল্পকলার বিকাশ ঘটে। তাজমহল, ফতেহপুর সিক্রি এবং দিল্লির লালকেল্লা মুঘল স্থাপত্যের সেরা নমুনা ।
 সম্রাট আকবর ১৫৮২ সালে দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রবর্তন করেন। এটি ছিল বিভিন্ন ধর্ম বর্ন মানুষের  মিলন মেলার অনন্য দর্শন। ঐ সময়ের মুসলিম দর্শন ও সংস্কৃতির উন্নতি ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তখনকার জ্ঞান, শিল্প এবং স্থাপত্যে মুসলমানরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী না হয়েও ভারত উপমহাদেশে সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব স্থানীয় ও মর্যাদাশীল ছিল ।
মোগল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে সম্রাটগনের কঠোর ধর্মীয় শাসন আরোপের ফলে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ লোপ  পায়, তাই ক্রমে মুঘল শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের আগমনের পথ উন্মুক্ত হয়।
(>> ৩য় পর্বে ‘ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের মুসলমান’  আগামী  বৃহস্পতিবার ৩রা জুলাই প্রকাশিত হবে )
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ড.ইদ্রিছ ভূইয়া

idris_bhuiyan@yahoo.com