অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
সাইফুল ইসলাম খাজা, কুমিল্লা প্রতিনিধিঃ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি, তিতাস, হোমনা ও মেঘনা থানার ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে ঘুষ ছাড়া কোনো সরকারি সেবা পাওয়া যায় না—এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর মুখে মুখে। এই চারটি থানার অন্তত ৩০টিরও বেশি ইউনিয়নে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান চালিয়ে উঠে এসেছে, সরকারি ফি জমা দিয়েও মানুষ সেবা পাচ্ছে না; বরং “দালাল ছাড়া কাজ হয় না”—এমন চিত্র স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
ঘুষ না দিলে ফাইল পড়ে থাকে ‘সিন্দুকে’
সরকারি নিয়মে নামজারি, খারিজ ও খাজনা বাবদ অনলাইনে ফি জমা দিলেই কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে ঠিক উল্টোটা। একাধিক ইউনিয়ন ভূমি অফিসে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নামজারি কিংবা খারিজ করতে গেলে ‘অফ দ্য রেকর্ড’ ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবি করা হয়। তা না দিলে ফাইল মাসের পর মাস পড়ে থাকে, কোনো অগ্রগতি হয় না।
দাউদকান্দির চরবাউশিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা হাজী শামসুল হক বলেন, “নামজারি ফাইল দিছি তিন মাস হইলো, অনলাইনে সব ঠিকঠাক, কিন্তু অফিসে গেলেই বলে ‘ভুল আছে’। পরে দালাল ধরলে বলে ৬০ হাজার টাকা লাগবে। টাকা দিলে এক সপ্তাহে হয়ে যাবে। শেষমেশ টাকা দিয়া করাইছি।”
ভূমি অফিসের ‘অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক’: দালালচক্র
তিতাস থানার জিয়ারকান্দি ইউনিয়নের এক ভূমি সহকারী কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন,
“অনেক সময় উপরের চাপে কিছু ফাইল রাখতে হয়। আবার অনেক গ্রাহক ঠিকমতো কাগজ জমা না দিয়ে কাজের তাড়া দেন। তখন বাধ্য হয়েই ‘মিডিয়েটর’ লাগে।”
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসেই একাধিক চিহ্নিত দালাল প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা প্রকাশ্যেই গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কাজ করিয়ে দিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব দালালদের পেছনে ভূমি কর্মকর্তারাই রয়েছেন। তারা প্রকাশ্যে টাকা নেন না, দালালরাই সব লেনদেন করে থাকেন।
অবৈধকে বৈধ বানানোর মেশিন?
বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, শুধু বৈধ ফাইল নয়—অবৈধ জমি দখল, ভুয়া দলিলের মাধ্যমে নামজারি, কিংবা তৃতীয় পক্ষের নামে খারিজ করার ঘটনাও পাওয়া গেছে। ঘুষের বিনিময়ে এসব কাজও হয়ে যাচ্ছে অনায়াসে।
হোমনা থানার এক ব্যবসায়ী জানান, “আমার প্রতিবেশী অবৈধভাবে আমার জমির একাংশ দখল করে নামজারি করেছে। পরবর্তী শুনানিতে দেখি ভূমি অফিস থেকেই নাকি রেজিস্ট্রেশন ‘সঠিক’ হয়েছে। পরে শুনি ৭০ হাজার টাকা দিয়া করেছে।”
জনগণের আস্থা ভঙ্গ, প্রশাসনের নিশ্চুপতা
চারটি থানার প্রায় ৪০ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভূমি অফিসে ‘সাধারণভাবে গেলে কিছু হয় না’। এক নারী কৃষক বলেন, “আমার ছেলের জমি আছে, ও শহরে থাকে। আমি কয়েকবার গিয়ে ফিরে আসছি, শেষে দালাল পাইয়া ৫০ হাজার দিয়া কাজ করাইছি। সরকার টাকা পায় ১৫০০, আর অফিস খায় হাজার হাজার!”
এমন অবস্থায় ভূমি অফিসের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
দুর্নীতি দমনে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেই কেন?
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“অভিযোগ আসলেও প্রমাণ পাওয়া কঠিন। বেশিরভাগ লেনদেন হয় দালালদের মাধ্যমে, সরাসরি হাতে-নাতে ধরা পড়ে না।”
ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, “সরকার সারা দেশে অনলাইন নামজারি চালু করেছে দুর্নীতি কমাতে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এসব ঘুষ বন্ধ করতে স্থানীয় প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত অভিযান প্রয়োজন।”
জনগণের দাবি: সাতক্ষীরার মতো উদাহরণ হোক কুমিল্লায়ও
স্মরণযোগ্য, ২০২৩ সালে সাতক্ষীরায় এক দুর্নীতিবাজ ভূমি কর্মকর্তাকে হাতেনাতে ধরে ১০ বছরের জেল দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। ঠিক একইরকম ব্যবস্থা কুমিল্লার দাউদকান্দি, তিতাস, হোমনা ও মেঘনা থানা অঞ্চলে নেওয়ার দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।
দাউদকান্দির এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দুর্নীতিমুক্ত দেশ চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন সরকারি অফিসেই সবচেয়ে বেশি অন্যায় হয়। এইসব অফিসারদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।”
উপসংহার:
ভূমি ব্যবস্থায় চলমান এই দুর্নীতির জাল ছিঁড়তে হলে চাই দুর্নীতি দমন কমিশন, জেলা প্রশাসন, ভূমি মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ। নয়তো সেবার নামে এই শোষণ চলতেই থাকবে—আর সরকার হারাবে জনআস্থা, সাধারণ মানুষ হারাবে ন্যায্য অধিকার।