স্টাফ রিপোর্টারঃ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় সার্কুলারের দাবিতে উত্তাল জাতীয় প্রেসক্লাব
মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্নভঙ্গ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ।
বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ৬০০-এর বেশি আসন শূন্য থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় সার্কুলার না দেওয়ায় হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে চরম হতাশা, ক্ষোভ এবং অধিকারবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিবাদে আজ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
এই মানববন্ধনে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক এবং মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের একটাই দাবি – অবিলম্বে দ্বিতীয় সার্কুলার প্রকাশ করে শূন্য আসনগুলোতে যোগ্য শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হোক। এই ঘটনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মল্লিকা খাতুনের বিরুদ্ধে একজন পিতৃহারা মেধাবী শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, যা জনমনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
ভর্তি পদ্ধতির অনিশ্চয়তা ও কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা
বাংলাদেশে চিকিৎসা পেশায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিকেল কলেজে ভর্তি একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি, যেখানে মোট আসন সংখ্যা ৫,৩৮০টি। অপরদিকে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে ৬৭টি, যেখানে মোট আসন সংখ্যা ৬,২৯৩টি। এর মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ আসন বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ থাকে।
সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রকার মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য ১০০ নম্বরের একটি লিখিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, যার পাশ নম্বর ৪০। মেধাক্রমের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। যারা সরকারি আসনে সুযোগ পান না, তারা বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারেন, যদি তারা লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে থাকেন। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে “অটোমেশন পদ্ধতি” অনুসরণ করা হয়, অর্থাৎ আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের মেধা অনুযায়ী কলেজ বাছাই ও স্থান নির্ধারণ হয় স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায়।
তবে, এই বছর চিত্রটা ভিন্ন। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথম সার্কুলারে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হলেও, এখনও ৬০০-এর বেশি আসন ফাঁকা রয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা: রুবীনা ইয়াসমিনও ২৯ মে গণমাধ্যমে এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অথচ, অতীতের নজির অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে তিনবার এবং ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষেও দুইবার ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল।
অর্থাৎ, শূন্য আসন থাকলে পুনঃভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ একটি নিয়মিত ও অলিখিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার কোনো পূর্ব নির্দেশনা ছাড়াই পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, “পোর্টাল বন্ধ হয়ে গেছে, তাই কিছু করা সম্ভব নয়” – এই অজুহাত মানবিকতার চেয়ে প্রযুক্তি-পদ্ধতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যা অগ্রহণযোগ্য।
যুগ্ম সচিব মল্লিকা খাতুনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ: একটি মর্মান্তিক ঘটনা
মানববন্ধনে আসা শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মল্লিকা খাতুনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। ইফতি নামের একজন পিতৃহারা এতিম ও মেধাবী শিক্ষার্থীর ফুপু মমতাজ বেগম জানান, ১৯ জুন ২০২৫ তারিখে তারা ইফতিকে নিয়ে সচিবালয়ে যান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সাথে কথা বলে দ্বিতীয় সার্কুলার বিষয়ে আবেদন করা। কিন্তু তাদের আবেদন মঞ্জুর না করে যুগ্ম সচিব মল্লিকা খাতুনের সাথে দেখা করতে বলা হয়।
মমতাজ বেগম জানান, মল্লিকা খাতুনের কক্ষে প্রবেশ করে তারা কথা বলতে চাইলে মল্লিকা খাতুন অত্যন্ত রূঢ় আচরণ করেন। তার মন্তব্যের একটি অংশ ছিল, “এগুলার কি বিষয়, ওরা দাঁড়ায় আছে কেন? সেকেন্ড টাইম ভর্তি হওয়া যাবে কিনা। সেকেন্ড টাইম ভর্তি হওয়া যাবে না। না করে দিয়েছে। এটা নিয়ে কেনো আলাপ নাই।”
আন্টি বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও মল্লিকা খাতুন তাদের কথা শুনতে অস্বীকৃতি জানান। ইফতির শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তার বাবা হারানোর কষ্টের কথা বলতে চাইলে মল্লিকা খাতুন বলেন, “কেনো কষ্টের কথা শুনতে পারব না। ওর স্ট্যাটাসটা বলেন। আমার ওই গল্প শুনে লাভ নাই। ও কেনো আবেদন করতে পারেনি সেটা বলেন।”
ইফতির ফুপু জানান, ইফতি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ৬৭.৫ নম্বর পেয়েছিল এবং তার একটাই স্বপ্ন সে ডাক্তার হবে। সে দরিদ্র মেধাবী কোটায় আবেদন করেছিল, কিন্তু সেখানে তার সুযোগ হয়নি। এরপর তারা সচ্ছল কোটায় আবেদন করতে চেয়েছিলেন। যখন বলা হয় তাদের কাছে ২৭ লাখ টাকা নেই, তখন মল্লিকা খাতুন ইফতিকে “মানসিকভাবে অসুস্থ” বলে মন্তব্য করেন।
সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যখন ইফতির ফুপু বলেন, ইফতি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হলে তিনবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। এর উত্তরে যুগ্ম সচিব মল্লিকা খাতুন বলেন, “লেট হার সুইসাইড।”
এই মন্তব্য উপস্থিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্তব্ধ করে দেয়। মমতাজ বেগম জানান, এরপর মল্লিকা খাতুন আরও বলেন, “কিন্তু সে তো মানসিক রোগী, তার পড়ার অধিকার নাই।”
এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে মোঃ মিজানুর রহমান মিজান নামে একজন আইনি পরামর্শদাতা মাননীয় সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বরাবর একটি আবেদন এবং যুগ্ম সচিব মল্লিকা খাতুন বরাবর একটি আইনি নোটিশ প্রেরণ করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, এই মন্তব্য একজন তরুণ শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে এবং আত্মহত্যার মতো গুরুতর অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়, যা Penal Code ৩০৬ ও ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যায় প্ররোচনা হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। তারা অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, আত্মহত্যা সংক্রান্ত মন্তব্য ও আচরণ বিষয়ে সরকারী কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের বিধান এবং ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার পরিবারকে মানসিক সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
স্বপ্নভঙ্গের অন্যান্য করুণ কাহিনি
ইফতির ঘটনার পাশাপাশি মানববন্ধনে উঠে আসে আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর হৃদয়বিদারক কাহিনি, যারা কেবল একটি দ্বিতীয় সার্কুলারের অভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দেখছেন:
* সুমাইয়া আক্তার জুথি (রোল: ২৮০১৫৫৭): যার বড় বোন যশোর মেডিকেলে পড়ার সময় কিডনি ও লিভার বিকল হয়ে মারা যান। বোনের চিকিৎসায় দেড় কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার পরও পরিবার চেয়েছিল জুথি ডাক্তার হয়ে বোনের স্বপ্ন পূরণ করুক। সে প্রথমবার চান্স না পেলেও দ্বিতীয়বারে ৭৫.৫ নম্বর পেয়ে ৬১০৭ পজিশনে আসে। জুথি দরিদ্র মেধাবী কোটায় আবেদন করলেও নির্বাচিত হয়নি। এখন আর্থিক সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও জেনারেল কোটায় পড়ার আগ্রহ থাকলেও দ্বিতীয় সার্কুলার না থাকায় সে ভর্তি হতে পারছে না।
তার পরিবার দ্বিতীয়বারের ট্রান্সপ্লান্টের পরেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে ডেঙ্গু এবং স্ট্রোকও ছিল। জুথির বোনের চিকিৎসার সব ফাইল, যশোর মেডিকেলের কার্ড এবং সংশ্লিষ্ট মেডিকেল প্রিন্সিপালের নম্বরসহ সব প্রমাণ তার কাছে আছে। বাংলাদেশ ডক্টর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট থেকেও তার বোনের চিকিৎসায় ১০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছিল।
* নাফিসা নাওয়ার: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং নিউ গভ: ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সে ৬৪.৩ নম্বর পেয়ে অল্পের জন্য সরকারি মেডিকেল কলেজে নির্বাচিত হয়নি। তার বাবা একজন পুলিশ অফিসার এবং মা একজন শিক্ষিকা। বাবা-মা দুজনেই নিজ নিজ পেশাগত ব্যস্ততার কারণে মেয়ের বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আবেদন প্রক্রিয়ায় ঠিকমতো সহযোগিতা করতে পারেননি। নাফিসা নিজেই একটি দোকানে গিয়ে আবেদন করে। কিন্তু দোকানদারের ভুলের কারণে বা তার প্রতারণার ফলে আবেদন নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ২০০ টাকা সরকারি টেলিটকের নির্দিষ্ট কোড নম্বরে জমা পড়েনি। ফলে নাফিসার রোল নম্বর দিয়ে কোনো মেডিকেল কলেজে ফলাফল আসেনি। বাবা-মায়ের দেশের সেবায় ব্যস্ততার কারণে মেয়ের জীবনের স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়ার এই ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
* মাহমুদা মারিয়ুম আখি (রোল: ৩৫০১৮৭৮): রংপুর আর্মি মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েও সেখানকার মাসিক খরচ ২৫ হাজার টাকা, যা অন্যান্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজের চেয়ে ৮-১০ হাজার বেশি হওয়ায় ভর্তি হতে পারেনি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও দ্বিতীয় সার্কুলার আসবে ভেবে সে কোথাও ভর্তি হয়নি। একজন সেকেন্ড টাইমার হিসেবে তার আর পিছনে ফেরার রাস্তা নেই।
* তাছলিমা জামান (রোল: ৪৪০০৭১০): একজন সেকেন্ড টাইমার। যশোর আর্মি মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিল। কিন্তু বাসা থেকে দূর হওয়ার কারণে সেখানে পড়ার মতো ব্যবস্থা করতে পারেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অফিসে যোগাযোগ করলে তাদের ১০০% নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল যে দ্বিতীয় সার্কুলার অবশ্যই দেওয়া হবে। এই আশ্বাসের উপর ভরসা করেই সে আর্মি মেডিকেলে ভর্তি হয়নি। এখন দ্বিতীয় সার্কুলার না আসায় তার বাবা-মায়ের স্বপ্ন এবং তার নিজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সে মনে করে, মৃত্যু পর্যন্ত এই একটাই হয়তো আফসোস থাকবে এবং সারাজীবন মানসিকভাবে শান্তি পাবে না।
* কানিজ ফাতিমা (রোল: ২২০১১৯৫): প্রথমবার আর্থিক কারণে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হওয়ার কারণে সে ভর্তি হতে পারেনি। প্রতি বছর দুবার সার্কুলার দেওয়ার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় এবারও দেবে ভেবেছিল। সে প্রশ্ন তুলেছে, ৬০০-এর বেশি আসন ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও কেন তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
* মাইমুনা আক্তার হিরা (রোল: ৪০০৩০১৩): প্রথমবার আবেদন করেছিলেন কিন্তু কারিগরি সমস্যার কারণে তার আবেদন ওয়েবসাইটে জমা হয়নি। যখন সবার কলেজ আসে, তখন তিনি বুঝতে পারেন কিন্তু ততক্ষণে আর কিছু করার ছিল না।
* সুমাইয়া আক্তার (রোল: ২২২০০৮৭৮): একজন সেকেন্ড টাইমার যিনি মেধাবী ও দরিদ্র কোটায় আবেদন করেছিলেন। তার মেরিট পজিশন ৮ হাজারেরও বেশি থাকা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যক্রমে তার নাম মেধা কোটার তালিকায় আসেনি। পরিবার তাকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাতে চায়। সে উল্লেখ করে যে, DGME কর্তৃক প্রকাশিত প্রথম সার্কুলারে উল্লেখ ছিল যে, যারা মেধা কোটায় বিবেচিত হবেন না, তারা পরবর্তীতে জেনারেল কোটায় আবেদন করার সুযোগ পাবেন। অথরিটির এমন আচরণকে তিনি হয়রানি হিসেবে দেখছেন। তিনি ১৫ জুন শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন করার সময় গুন্ডা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলারও অভিযোগ করেন।
* নিঝুম জাহান তন্নী (রোল: ৪০০১৫৪২): প্রথমবার মেধাবী কোটায় আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ডিজিএমই অফিসে গেলে তাকে আশ্বাস দেওয়া হয় যে দ্বিতীয় সার্কুলার অবশ্যই দেওয়া হবে। এই আশ্বাসে তার বাবা পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে জমি বিক্রি করে টাকা প্রস্তুত রাখেন। কিন্তু এখন সময় পার হয়ে গেলেও সার্কুলার দেওয়া হচ্ছে না এবং কর্তৃপক্ষ কথা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। একজন সেকেন্ড টাইমার হিসেবে ডাক্তার হওয়ার একমাত্র লক্ষ্য পূরণ না হলে তার এই আফসোস আজীবন থাকবে বলে তিনি জানান।
কর্তৃপক্ষের নীরবতা ও পূর্বপ্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে সারা দেশে একযোগে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মোট অংশগ্রহণকারী ছিলেন ১,৩১,৭২৯ জন, যার মধ্যে ৬০,০৯৫ জন শিক্ষার্থী পাশ করেন। সরকারি আসনের বাইরে যারা মেধাক্রমে সুযোগ পাননি, তাদের বড় একটি অংশ বেসরকারি কলেজে ভর্তি হন। তবুও ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরেও প্রায় ৬০০টির বেশি আসন ফাঁকা রয়ে গেছে।
শিক্ষার্থীরা বারবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর (DGME) বরাবর স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন, কিন্তু তাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়নি। এমনকি, ২৬ এবং ২৮ মে তারিখে স্মারকলিপি জমা দেওয়ার সময় DGME-এর পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা: মহিউদ্দিন মাতুব্বর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করে বলেন, “তোমরা তো হাসিনাকে নামানোর সময় আমাদের বলো নাই, তাহলে এটাও তোমরা আমাদের কাছে আসছো কেনো? আন্দোলন করে এটাও করো।”
১৫ জুন ২০২৫ তারিখে সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সামনে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করার সময় বেলা ২টার দিকে অধিদপ্তরের একজন কর্মচারী বাইরে থেকে এলাকার কিছু ছেলেদের ডেকে এনে শিক্ষার্থীদের মারধর করে। এমনকি তারা মেয়েদের এবং অভিভাবকদের গায়েও হাত তোলে। এই হামলার তীব্র নিন্দা ও বিচার দাবি করেছেন আন্দোলনকারীরা।
প্রচারণা লিফলেটে শিক্ষার্থীরা বলছেন, “রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য একটাই-স্বাস্থ্যসেবায় আত্মনিয়োগে আগ্রহী মেধাবীদের পথ রুদ্ধ না করা, বরং যথাযথভাবে তাদের সম্পদে রূপান্তরিত করা। শূন্য আসন পূরণে দ্বিতীয় দফা ভর্তি তারই একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।” তারা আরও উল্লেখ করেন, এখানে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি হতে চাচ্ছে, তারা নিজস্ব অর্থায়নে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করবে। এখানে সরকারের কোনো ভর্তুকি বা অর্থায়নের প্রয়োজন নেই। তাহলে প্রশ্ন উঠে, সরকারি ব্যয়ের বাইরে থেকেও যদি শিক্ষার্থীরা নিজেদের খরচে মেডিকেলে পড়তে চায়, তাহলে তাদের সেই সুযোগ কেন আটকে রাখা হচ্ছে?
দাবি ও প্রত্যাশা
মানববন্ধন থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের স্পষ্ট দাবিগুলো তুলে ধরেছেন:
* ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের শূন্য আসন পূরণে অবিলম্বে দ্বিতীয় দফা ভর্তি সার্কুলার প্রকাশ করতে হবে।
* ২৫ মে’র আগের দেওয়া সরকারি মৌখিক আশ্বাসের ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
* “পোর্টাল বন্ধ” অজুহাত তুলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস না করে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে তা পুনরায় খুলতে হবে।
* ১৫ জুনের হামলার ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
* বিশেষ করে সেকেন্ড টাইমার শিক্ষার্থীদের কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করে দ্বিতীয় সার্কুলার দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা মনে করেন, যেখানে আসন ফাঁকা রয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে আগ্রহী, সেখানে কোনো কিছু বাধা হওয়ার কথা নয়। তারা তাদের দাবিতে অনড় আছেন এবং বারবার অনুরোধ করেও কোনো লাভ না হওয়ায় অপমান ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তারা কর্তৃপক্ষের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, “যে সরকার ছাত্রদের রক্তের উপরে দাঁড়িয়ে আছে, তারা এখন ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানতে নারাজ। তারা কি ভুলে গেছে জুলfই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের কথা?”
এই সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে দেশের স্বাস্থ্য খাতের ভবিষ্যত হুমকিতে পড়বে এবং অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বপ্ন অকালে ঝরে যাবে। এই বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার নজরে এনে সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তারা আশা করছেন, সরকার মানবিকতার দিক বিবেচনা করে তাদের দাবি মেনে নেবে এবং দেশের মেধাবী সন্তানদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করবে।