ক্ষুধার্ত গাজার কান্না এবং মানবতার মুখোশধারীরা

54
ফাইল ছবি

গরিবের বারবার ক্ষুধা লাগে, কিন্তু খাদ্যের অভাব। ধনীদের সামনে খাবারের প্রাচুর্য, অথচ ক্ষুধা নেই। চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে যুদ্ধপীড়িত ফিলিস্তিনে শুরু হয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সবচেয়ে করুণ অবস্থা গাজায়। শিশুদের দেহ হাড্ডিসারে পরিণত হয়েছে। মায়েদের বুকে আর দুধ নেই। যতদূর চোখ যায়, ধ্বংসস্তূপ আর ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার।

আন্তর্জাতিক রিলিফ আসছে সামান্যই। রিলিফবাহী ট্রাক ও জাহাজ আটকে দেওয়া হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। প্রয়োজনের তুলনায় ফান্ডও অনেক কম। সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হচ্ছে—যে রিলিফ এসেছে, তার মধ্যেও কখনো আটার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভয়ংকর মাদক। জায়নবাদীরা চায়, ফিলিস্তিনিদের জন্য শুধু কাফনের কাপড় পাঠাতে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা গাজার বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে। আমেরিকার তথাকথিত মানবতাবাদ অস্ত্র বাণিজ্যের পথেই হেঁটে চলে।

ফিলিস্তিনের যাদেরকে বোমা-বারুদে হত্যা করা সম্ভব হয়নি, তারা এখন মরছে ক্ষুধায়। শিশুদের মুখের দিকে তাকানো যায় না, পুরুষের দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই, নারীদের দেহ অবশ হয়ে গেছে। কখনো কখনো হায়েনার দল ত্রাণের লাইনে গুলি করে প্রাণও কেড়ে নেয়। পৃথিবীটা আর কতদিন মানুষের থাকবে—সে প্রশ্ন উঠেছে। যুদ্ধবাজ শাসকদের টিনের চশমায় গাজাবাসীর আর্তনাদ কোনো অনুভূতির জন্ম দেয় না। মানবতার লেকচারে তারা মিডিয়াপাড়া সরগরম করে রাখে, অথচ ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর পথে হাঁটতে থাকা মানুষদের জন্য সামান্য সহানুভূতিও দেখায় না। ধিক সেই মানবতার বুলি, শত শত, হাজার হাজার!

গাজাবাসীর দুর্দশার কথা বলতে গেলেই বদদোয়া এসে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ও মুসলিম দেশগুলোর ওপর। বিশেষ করে মনে হয়, মক্কা-মদিনা এবং রাসূল সা. ও সাহাবিদের কবর না থাকলে এতদিনে সৌদি ধ্বংস হয়ে যেতো! দিনে দিনে পাপ বাড়ছে। রাষ্ট্রটি একদিনে যে পরিমাণ খাবারের অপচয় করে, তা দিয়ে ফিলিস্তিনের ক্ষুধার্তরা তিনদিন পেট ভরে খেতে পারত। অথচ তারা শুধু উদাসীন নয়, বরং হত্যাকারীদের প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের প্রথম সফর সৌদি ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে হয়—এটা কি নিছক কাকতাল? স্বার্থের বাইরে কিছুই না। মুসলমানদের হত্যায় ব্যবহৃত প্রতিটি বুলেটের পেছনে থাকে সৌদি, কাতার ও কুয়েতের আর্থিক অবদান।

এই যে গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসরাইলের মোড়লগিরি—এই শক্তির জোগান আসে কোথা থেকে? আমেরিকা ও তার মিত্রদের কাছ থেকে। কিন্তু এই সহায়তা কি তারা নিজেদের অর্থ থেকে দেয়? মোটেই না। মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো-বাণিজ্যের আড়ালে চুষে নেওয়া অর্থেই ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখা হয়। ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত শিশুর কান্না, ইরান-ইরাক-লিবিয়া-আফগানিস্তানে মুসলিম রক্তের বন্যায়, সৌদি-কাতার-কুয়েত-জর্ডান-বাহরাইনের নির্লজ্জ অংশীদারিত্ব আছে। ভাইকে হত্যার বরাত দেয়া হয় এই তথাকথিত মুসলিম মোড়লদের মাধ্যমে।

ফিলিস্তিনের ক্ষুধার্ত শিশুদের আর্তনাদ নিশ্চয়ই আল্লাহ শুনবেন। প্রাচীন মিশরের মতো আবার এই জমিন ঊষর হয়ে উঠবে। বিশ্ববাসী যেভাবে নিরন্ন শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা দিচ্ছে, তার বহুগুণ শাস্তি তাদের অপেক্ষায় আছে। বায়তুল মুকাদ্দাসের পবিত্র ভূমিতে বিচরণকারী অভিযোগ-রব নিশ্চয়ই আমলে নেওয়া হবে। যারা দানবদের সঙ্গী হয়েছে, ইতিহাস ও আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে গোলামি বেছে নিয়েছে, তাদের পরিণতি ভয়াবহ হবে। নিজের খোঁড়া গর্তেই পচে মরতে হবে।

ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রতিটি ঈমানদারের দায়িত্ব। আমরা যে ভ্রাতৃত্বের কথা বলি, তার বাস্তবায়ন নির্ভর করে ওই ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখে হাসি ফোটানোর ওপর। মর্যাদার সঙ্গে মরতে পারার অধিকার সবার থাকা উচিত। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে করা অন্যায় যারা দেখেও চুপ থেকেছে, জালেমদের সহায়তা করেছে—আল্লাহ তাদেরও ছেড়ে দেবেন না।

দুনিয়ায় ন্যায়বিচার হয়তো অসাধ্য, কিন্তু আখিরাতে এক দানা অন্যায়ও কৈফিয়ত ছাড়া যাবে না। নিরন্নকে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া মানুষের মানবিক দায়িত্ব। আরবদের নির্বিকার নীরবতা, পশ্চিমাদের পক্ষপাতদুষ্ট মানবতার সংজ্ঞা এবং মানুষের ওপর অমানবিক নির্যাতন—সবকিছুর ফলাফল এই দুনিয়াতেই শুরু হবে এবং চলবে আখিরাতে অনন্তকাল। ফিলিস্তিনের শিশুদের ক্ষুধার্ত আর্তচিৎকার শুনে কী করে খাই, কী করে ঘুমাই? বিবেক না থাকলে তাকেও কি মানুষ বলতেই হবে?

রাজু আহমেদ,  প্রাবন্ধিক।  

raju69alive@gmail.com