ভারত উপ মহাদেশে মুসলমানদের অবস্থান :
ইংরেজ আমলে (বিশেষ করে পলাশীর যুদ্ধের পর) গোঁড়া মুসলিমদের অবস্থা ছিল বেশ কঠিন। তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে, যা তাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয় বাস্পীয় ইঞ্জিন আবিস্কার হয়, রেল যোগাযোগ এবং কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। গোরা মুসলমান শ্রেনীর উদ্ভব হয়, যারা বৈশ্বিক অগ্রগতির তাল মিলাতে চায় না। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ করে শিয়া ও সুন্নিদের উচ্চ শ্রেনী ইংরেজদের সাথে শিক্ষাধিক্ষা ও উন্নয়নে সহযোগী হয়ে উঠে।
ইংরেজ শাসনের শুরুর দিকে, মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত হতে থাকে এবং তাদের সামাজিক অবস্থানও দুর্বল হতে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিন্দুদের সমর্থন করে এবং মুসলমানদের থেকে দূরে থাকে। এর ফলে, মুসলিমরা সরকারি চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও মুসলমানরা পিছিয়ে ছিল। ইংরেজ শিক্ষা থেকে তারা দূরে ছিল এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা মাদরাসা শিক্ষাও গুরুত্ব হারাতে থাকে।
পলাশীর যুদ্ধের পর, মুসসমানদের মধ্যে ইংরেজদের প্রতি একটি বিদ্বেষ তৈরি হয়, বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার তাদের আরও কঠোরভাবে দমন করে।
মুসলিম নেতা মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানউতবী এবং মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী। ১৮৬৬ সালের ৩০ মে, দেওবন্দের সাত্তা মসজিদে, দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। সিপাহী বিদ্রোহের পর মুসলমানদের ধর্মীয় ও শিক্ষাগত ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।
অতপর ১৮৭৫ সালে দার্শনিক ও শিক্ষানুরাগী সৈয়দ আহাম্মদ খান দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, মুহাম্মাদান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। (পরে স্যার উপাধি প্রাপ্ত) স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আলীগড়ে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুসলমান সমাজকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেন।
অন্যদিকে, কিছু গোঁড়া মুসলিম গোষ্ঠী ছিল যারা ইংরেজদের বিরোধিতা করে আসছিল এবং তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি রক্ষার জন্য চেষ্টা করছিল।
মোটকথা, ইংরেজ আমলে গোঁড়া মুসলিমদের অবস্থা ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়াশীল। একদিকে তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, অন্যদিকে তাদের মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক চেতনার বিভক্তি থাকলেও জাগরণ ঘটেছিল এবং তারা নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়ে ক্রমশ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সচেষ্ট হয়ে উঠেন।
মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী উচ্চ শিক্ষিত, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা। দুজনেই খিলাফত আন্দোলনের মূল নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন। মুহাম্মদ আলি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ও হয়েছিলেন। শওকত আলি তার ভাই মুহাম্মদ আলিকে উর্দু সাপ্তাহিক হামদর্দ ও ইংরেজি সাপ্তাহিক কমরেড প্রকাশ করতে সাহায্য করেন। তারা আজীবন ভারতের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তারা ইতিহাসে ‘আলী ভ্রাতৃদ্বয়়়’ নামে পরিচিত।
মুহাম্মদ আলী ১৮৭৮ সালে ১০ ডিসেম্বর উত্তর প্রদেশের রামপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাওলানা শওকত আলি ও জুলফিকার আলির ভাই। উভয়ে দারুল উলূম দেওবন্দ, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক ইতিহাস অধ্যয়ন করেন।.
এভাবে ভারত থেকে ইংরেজ উপনিবেশ শাসন বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠে।
(চলবে ৪র্থ পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার)

লেখক
বীর মুক্তিযোদ্ধা ড.মুহম্মদ ইদ্রিছ ভূইয়া








