ক্ষমতা, সম্পদ ও উত্তরাধিকারের জবাবদিহি

83

কী করছি এবং কেন করছি? ভেবে করছি তো? এটা তো সেই মাটি, যার ওপরে আমাদের পূর্বপুরুষ স্থায়ী হতে পারেনি। এখানে সেই ভবিষ্যৎ বিদ্যমান, যেখানে পরবর্তী প্রজন্মও চিরকাল থাকবে না। ন্যায়হীন ক্ষমতা কিংবা অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ কাদের জন্য, কোন আশায় জমা করছি? মানুষকে ঠকিয়ে, অন্যের অধিকার হরণ করে কিংবা দুর্বলকে কষ্ট দিয়ে চিরকাল থাকা গেলে এসব অন্যায় না হয় মানা যেতো।

যেখানে পরিণতি স্থায়ী ফ্রেমে বাঁধা, পূর্বঘোষিত পরিকল্পনায় সব কর্মের কর্মফল ভোগ করতে হবে এবং পুরস্কার ও শাস্তির রূপরেখা নির্ধারিত—সেখানে মানুষ বেকুব না হলে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় করতে পারে না। প্রত্যেকটি কথা ও কাজের জন্য জবাবদিহি আছে, সেটা নিশ্চিতভাবে জানার পরেও মানুষের অন্তরে ভয় না ধরা ভয়ংকর পরিণতির নির্দেশ করে।

বৈধ-অবৈধের ব্যবধান ভুলে যে সম্পদ জড়ো করার প্রতিযোগিতায় নেমেছি, সেই সম্পদ ভোগ করে যেতে পারবো? এই সম্পদ সন্তানের উপকারে আসবে নাকি ধ্বংসের কারণ নিশ্চিত করবে—তা জানি? সন্তানকে যদি প্রকৃতার্থে সম্পদশালী করতে চাই, তবে যেন সুশিক্ষা নিশ্চিত করে যাই। ভালো-মন্দের ব্যবধান শেখানো, ন্যায়বোধে বেঁধে রাখা এবং তাকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে সেটা সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদে পরিণত হবে।

অনেকেই সন্তানের জন্য এমন অযাচিত সম্পদ স্তূপ করে রেখে যান, যা সন্তানকে সাক্ষাৎ অথর্বতে পরিণত করে। সন্তানকে সংগ্রাম শেখান, সংকট মোকাবিলা করতে দিন এবং সত্যকে গ্রহণ করতে আগ্রহী করে তুলুন। তবেই সন্তান উপকারী সম্পদে পরিণত হবে।

পূর্বপুরুষদের ক্ষমতার কথা ভাবুন। এখন কই তারা? মাটিতে হাড্ডিরও অস্তিত্ব নাই। অথচ কত দাপট ছিল! লাঠালাঠি করে, আইল ঠেলা কিংবা দুর্বলকে পিষে মারা—দুনিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও তাদের সেই ক্ষমতার উপকারী কিছু পাওয়া যাবে? মানুষ মূলত শেখে না। রক্ত পরিশোধনের চিন্তা যদি কাজ করতো, তবে কেউ প্রতিশোধের জন্য বেপরোয়া হতো না।

ক্ষমতার সামনে নত হওয়া, সম্পদের লোভে আত্মমর্যাদা বিক্রি করা এবং অন্যায়ভাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা—এসব রক্তের দোষ। যে প্রজন্ম স্বউদ্যোগে নিজেদেরকে শোধরায়নি, তারা সভ্যতার সংস্পর্শে আসেনি। অনেক মানুষের সম্পদ আছে, অথচ অমানুষ। অনেকের ক্ষমতা আছে, অথচ পশু। ভালো মানুষ সব সময় বড় মানুষ হয়ে ওঠেন।

কারো বিপদের দিনে সাহায্য ও পরামর্শের জন্য তার যদি আপনার নাম স্মরণে আসে, তবে সে জীবন ধন্য। কেউ যদি ভরসা করে, সুফল পায় এবং ক্ষতির হওয়ার দুশ্চিন্তামুক্ত থাকে তবে আপনার জীবন আলোয় উদ্ভাসিত। সে জীবনে ক্ষমতা ও সম্পদ নাও থাকতে পারে, তবে অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। শতবর্ষ পরে এই মুহূর্তে অস্তিত্বশীলদের কেউ থাকবো না। কাজের আলো যাতে তখনো ছড়িয়ে থাকে।

জীবনের আলোকিত দিক ভালো কাজের মাধ্যমে উন্মোচিত হলে, সে জীবন প্রাচুর্যময়। একবার যে জীবন পেয়েছে, সে জীবন যাতে ভ্রষ্টদের জীবনের সাথে মিশে না যায়।

যেহেতু প্রত্যেকটি কথা ও কাজের কৈফিয়ত আছে, সেহেতু তা পুরস্কার প্রার্থী হোক। দায়িত্বও আমানত। ক্ষমতা যাতে মানুষের কল্যাণে আসে। সম্পদ নেয়ামত। সামর্থ্য যাতে অসহায়ের উপকারে আসে। রেখে যাওয়া প্রতিটি পদক্ষেপে ভবিষ্যতের জন্য কল্যাণের বার্তা থাকুক।

ক্ষমতার সময়টা যাতে এমন আগ্রাসের না হয়, যাতে ক্ষমতাহীন দিনে পালিয়ে বেড়াতে হয়। সম্পদের উৎস যাতে এমন কোনো দাগ না থাকে, যাতে দুনিয়ার আইন ও দুদক প্রশ্ন তোলে। সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও বিবেক যাতে অভিশাপ না দেয়।

স্রষ্টাকে ঠকালে তিনি সৃষ্টিকে ক্ষমা করবেন—যেহেতু অসীম তিনি। তবে কারো হক ঠকালে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে এবং কষ্ট দিলে, ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিশ্চিত হয়ে যেও। নয়তো মুক্তি অসম্ভব।

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।  

raju69alive@gmail.com