বলছি তোমায় ইতিহাসের গল্পের – ৪র্থ পর্ব

0
615
ছবি- সংগৃহীত

‘কাশ্মীর  ভূ-স্বর্গ  ভূ-নরক উভয়ই’

আজ যেই পর্বটি লিখছি এইটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, ধর্মের ভিত্তিতে দাঙ্গা হাঙ্গামা, ভারতবাসীদের নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটির হৃদয়বিদারক  জটিল বিষয়। এইগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করছি। একটি কাশ্মীর অঞ্চল। দ্বিতীয়টি পাঞ্জাব অঞ্চল এবং তৃতীয়টি বাংলা বা বেঙ্গল অঞ্চল।

ভারত উপমহাদেশ জুরে বৃটিশ সাম্রাজ্যকে কর দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করা এমন ৫৬২টি ‘করদরাজ্য’ ছিল। যেই রাজ্য গুলির শাসনকর্তা  থাকতেন সংশ্লিষ্ট  মহারাজা বা নবাবগন।  এমনি একটি করদরাজ্য ছিল কাশ্মীর। যার শাসন কর্তা ছিল মহারাজা হরি সিং।

ছবি- সংগৃহীত

বৃটিশ কতৃক ১৯৩৫ সালে জারীকৃত’ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্ট এক্ট’ বা ভারত স্বাধীনতা আইনের শর্ত  অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে যখন ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে, তার আগ থেকেই কাশ্মীর করদরাজ্যের প্রজারা মহারাজা হরি  এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিল সম্পুর্ন  স্বাধীনতা লাভের জন্য। আন্দোলনে অন্যতম দলটি ছিল কাশ্মীর  ন্যাশনাল কনফারেন্স যার নেতা ছিল শেখ আব্দুল্লাহ। জহুরলাল নেহরু যদিও এলাহাবাদে  জন্ম গ্রহন করেন তার পিতা মতিলাল নেহরু ছিলেন কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ। তাই কাশ্মীরের সাথে তার নাড়ির টান ছিল। শেখ আব্দুল্লাহ ছিল নেহেরুর ঘনিষ্ট বন্ধু। কমিউনিস্ট আদর্শে স্বাধীন রাষ্ট্র  করার আন্দোলনে মহারাজা আব্দুল্লাহকে কয়েকবার কারাগারে নিক্ষেপ  করেছিল।

যখন ভারতবর্ষ  জুরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে  ‘দেশ ছাড়’ আন্দোলন তুঙ্গে। তখন জহুরলাল নেহেরু ভারত জাতীয় কংগ্রেসের নেতা। এদিকে ১৯৩৫ সালের  ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্টের বিধান অনুযায়ী ভারতে স্বাধীনতার কাজটি সম্পন্ন করতে বৃটিশ সরকার লর্ড মাউন্ট ব্যাটন কে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করে দিল্লিতে পাঠিয়েছেন। তিনি ভারত উপমহাদেশকে পাকিস্তান ও ভারত দুটি রাষ্ট্রে বিভক্তি করে স্বাধীনতা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেন। এবং কাশ্মীরসহ সকল করদরাজ্যের রাজা বা নবাবদেরকে তাদের পছন্দমত, পাকিস্তান অথবা ভারতের সাথে আসার জন্য নির্ধারিত নিয়মে “ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেসান”  স্বাক্ষর করতে নির্দেশ করেন।

কাশ্মীরে রাজার অধীনে থাকা প্রজারা ভারতের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত না হয়ে নিজেরা একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র করার আন্দোলনে ব্যস্ত। কিন্ত মাউন্টব্যাটেনের কাশ্মীর রাজ্যে  উক্ত  আইনের শর্ত বা বিধানের বাহিরে তার কিছু করার ছিল না। এদিকে অধিকাংশ করদরাজ্য “ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেসান” স্বাক্ষর করে একটি শান্তিপূর্ণ সিষ্টেমে চলে আসে।

শেখ আব্দুল্লাহ একপর্যায়ে   রাজাকে হাতে এনে কাশ্মীরকে ভারত ডমিনিউনের বাহিরে রেখে কাশ্মীর পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র করার পায়তারা করে। ইংরেজ শাসকদের নিকট থেকে  সমর্থন না পেয়ে, রাজা  আন্দোলন দমনের  নামে ভারতীয় সৈন্যের সহায়তা চায়। এদিকে মাউন্টব্যাটেন, নেহেরু  বিশাল ভারতে দাঙ্গাদমন নিয়ে ব্যস্থ। এক দিশেহারা বেহাল অবস্থা। ঠিক তখনই পাঞ্জাবের নির্মম  দাঙ্গার মধ্যে কাশ্মীরের পশ্চিমাঞ্চলের  কিছু উপজাতি  স্বাধীনতা ঘোষণা করে পাকিস্তানের সমর্থনে চলে যায়। মহারাজা  “ইনস্ট্রুমেন্ট   অব অ্যাকসেসান” স্বাক্ষর না করে বিলম্ব সৃষ্টির ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়। তখন জহরলাল নেহেরুর কাছে আব্দুল্লাহ  বিশেষ সুবিধার আশ্বাসে স্বাধীন ভারতের সাথে কাশ্মীর থাকবে এই অঙ্গীকারে মাউন্টব্যাটেন এর কাছে মহারাজাকে নিয়ে  ইন্সট্রুমেন্টে স্বাক্ষর করান এবং তিনি কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হন। এই ধারাবাহিকতায়  নেহেরুর আশ্বাসের ফলশ্রুতিতে ১৯৫০ সালে ভারতের  সংবিধান প্রণয়নের সময়  সংবিধানে ৩৭০ ধারা সংযত করে কাশ্মীরকে ভারতের বিশেষ অঞ্চল হিসাবে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের  সুবিধা করে দেওয়া হয়।

ফলে একই ভারতের মধ্যে কাশ্মীরে পৃথক সংবিধান, পৃথক পতাকা, পৃথক রাষ্ট্রপতির সরকার চালু হয়। অধিকাংশ ভারতবাসী এই সুবিধাকে শেখ আব্দুল্লাহ ও নেহেরুর ঘনিষ্ট রাজনীতির ‘অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত’ বলে মনে করে।

অন্যদিকে কাশ্মীরের পশ্চিমাংশ আজাদ কাশ্মীর নামে একটি রাষ্ট্র গঠন করে যা আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানের অংশ হিসাবে স্বীকৃত। এই দুই কাশ্মীর একে  অন্যের সাথে দীর্ঘ ৭৫ বৎসর যাবত বিবাদে লিপ্ত। সাথে পাকিস্তান ও ভারতও।

২০২৩ সালে ভারতের বিজেপি সরকার সংবিধানের উক্ত ধারা বাতিল করলেও বিগতদিনের ধর্মের লেবাসে  ক্ষমতার লোভের এই পরিণাম ভারতের শান্তিপূর্ণ  ঐতিহ্যবাহী  মুসলমানদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে।

তাই কাশ্মীর বাহ্যিক রূপে ভূস্বর্গ হলেও হৃদয়ে রক্তাক্ত ভূ-নরক।

(চলবে – পরবর্তী অংশ আগামী  বৃহস্পতিবার)

লেখক-

বীরমুক্তিযোদ্ধা ড.মুহম্মদ ইদ্রিছ ভূইয়া, এডভোকেট সূপ্রীম কোর্ট ,

কলামিস্ট ও সাবেক কনসালটেন্ট এডিবি ও ওয়ার্ল্ড  ব্যাংক গ্রুপ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here