বিবেক বিক্রি আর বিলাসিতার হিসাব-নিকাশ

72

আমার অনেকগুলো অপরাধের আপনি কারণ। অযৌক্তিক মনে হচ্ছে? একই পরিবেশে বড় হয়েছি, একই গ্রেডে চাকরি করছি, কিংবা পাশাপাশি অফিসের উদ্দেশ্যে রোজ হাঁটছি—অথচ আপনার অনেক কিছু হয়েছে! গাড়ি, বাড়ি—আর আমার মাসই চলে না। বোঝেন বুঝি? কিছুই বুঝি না! ক্ষুধা যেহেতু আপনারও আছে, আমারও আছে, রোগ-শোক আপনারও হয়, আমারও হয়, মাসের শুরুতে দুজনকেই বাড়িতে কিছু টাকা দিতে হয়—তবুও আপনার সম্পদ জোয়ারের মতো বাড়ছে কেমনে? স্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করে, “তোমার সে বন্ধু এতোকিছু করতে পারে, অথচ তুমি তো ভাত-কাপড়ই ঠিকমতো দিতে পারো না!” পাশের ফ্ল্যাট থেকে রোজ বিরিয়ানির সুগন্ধ বেরোয় আর আমার সন্তান খেতে বসে দেখে থালায় পাটশাক! এরপরেও বলেন প্রশ্ন জাগে না!

মানসিক অসুস্থতা তো সাংঘাতিক সংক্রামক। আপনাকে দেখে দেখে আমারও তেলে-ঝালে বাবু সেজে চলার শখ জাগে। আপনার বউয়ের মতো আমার বউকেও দামী শাড়ি আর বাহারি গহনায় পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখতে পারলে বেশ হতো। বেতনের বেসিকের চেয়ে বেশি বেতনের স্কুলে আপনার সন্তান পড়ে! ইস! আমার সন্তানকেও যদি সেখানে পড়াতে পারতাম! আচ্ছা, সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি ধর্মবই আছে? সুশাসন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সম্পর্কে সেখানেও পাঠ দেওয়া হয়? সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পাঠশালা সেগুলো? থাক, বাদ দিন! আপনার সন্তানের মতো আসরের সন্তান যদি আমিষে-স্নেহে বড় হতো, তবে বোধহয় আপনার ল্যাদার মতো আমার গ্যাদারও বুদ্ধি হতো!

বেতনে তো এসব কুলোয় না! মায়ের চিকিৎসা, বাবার ওষুধ, বাসাভাড়া, দু’বেলা ডাল-ভাত এবং কাপড় কিনে কীভাবে মাস চলে? ভাই, আপনি পারেন কেমনে? খোদা বোধহয় আপনাকেই বেশি দয়া করেছে! পকেটের সাথে প্রয়োজনের তালমিল করতে গেলে আমি তো অন্ধকার দেখি। লোকমুখে শুনলাম, ঢাকায় ফ্ল্যাট করেছেন, উত্তরবঙ্গে পাহাড় কিনেছেন এবং দক্ষিণবঙ্গে সমতল ভূমি! আপনার যা বিত্তের কথা শুনি, তাতে কবরের জায়গাটুকু একবারে জান্নাতে কিনলেই পারেন! জানেন নাকি—সেখানে জমি বিক্রি করা শুরু হইছে? আপনাকে দেখে হিংসা হয়। কত ভাগ্যবান আপনি। সমবয়সী হয়েও আমার দুই টাকা সঞ্চয় নাই, অথচ শত্রুর হিসেবেও আপনার সম্পদ কোটির টাকার নিচে নামে না! আমি বোধহয় এখনো বিবেক বিক্রি করতে পারিনি, অথচ আপনি কিনে নিচ্ছেন পুরো দুনিয়া। এত সম্পদ রেখে কবরে ঘুমাবেন কেমনে? ফেরেশতারা খোঁজখবর নিতে আসবে না?

ভাববেন না, আপনার সাফল্যকে হিংসা করি। আরও সম্পদ গড়ুন, আরও বেশি টাকা! লোকেরা কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেওয়ার আগ পর্যন্ত অবৈধভাবে আয় করা থামাবেন না! মানুষের অভিশাপে নাক পর্যন্ত না ডুবলে হাত বাড়িয়ে চাওয়া বন্ধ করবেন না! দায়িত্ব ও দেশ বিক্রি করে দিন! আপনি ব্যবসায়ী। বিবেককে তালাবদ্ধ করে যাদের জন্য সম্পদ সংগ্রহের নেশায় ডুবেছেন, তাদের একজনেও আপনার অপরাধের দায় নেবে। সন্তানের দু’একটি কুলাঙ্গার হবে। স্ত্রী/স্বামী অবাধ্য। বলছি না আপনার সন্তান অস্বাভাবিক হবে। কিন্তু কেউ কেউ পরীক্ষায়, আবার কেউ কেউ পাপের প্রায়শ্চিত্তে দু’একটা অস্বাভাবিক সন্তানের বোঝা বহন করে আজীবন! আমার সামাজিক অবস্থানকে নাজুক করে দেওয়ার জন্য আপনি সারাজীবন মানসিক অস্বস্তিতে ভুগবেন—এর বেশি অভিশাপ আপনাকে দিতে চাই না।

কার কত টাকা বেতন তা প্রকাশ্য, কিন্তু আয় কার কত তা অনেকেই জানি না! লাইফস্টাইল, অহংকার আর পরিবারের সদস্যদের আভিজাত্য দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি! কারো কারো চকচকে বাড়ি, ঝকঝকে গাড়ি এবং পোশাকের শ্রী দেখেও বুঝতে পারি—বিবেক কখন, কোথায় বিক্রি হয়েছে। আয়ের চেয়ে যাদের সঞ্চয় বেশি, সম্পদের চেয়ে যাদের ব্যয় বেশি—তাদের হিসাবগুলো কি জটিল? মানুষ আসলে বুঝতে পারে—ডাল মে কুছ কালা হে!

আপনার দেখাদেখি কখনো যদি নিজেকে বিপন্ন অনুভব করি, অপরাধবোধ জন্ম হয় মনে—তবে সে দায়ের অধিকাংশ আপনার! যেমন করে কাবিলের কাছে আজও সব খুনের হিস্যা যায়। ফিরে আসুন। প্রয়োজনে পেশা পরিবর্তন করুন। অবৈধ অর্থ ভালো মানুষের জন্য বিষ! যদি কারো ক্ষেত্রে দেখেন অন্যায় করেও ভালো আছে, টিকে গেছে—তবে নিশ্চিত জানবেন, সে মানুষের খাতা থেকে পুরোপুরি মুছে গেছে। আশেপাশে অমানুষের সংখ্যা অল্প নয়। সে গল্প আজ থাক।

ফুটনোটঃ এই লেখায় ‘আমি’ সততার নির্দেশক এবং ‘আপনি’ মানে অসততার নির্দেশক।

রাজু আহমেদ,  প্রাবন্ধিক।

raju69alive@gmail.com