মানুষের সমাজে দানবের উল্লাস—আর কতকাল?

52
প্রতীকি ছবি।

বাংলাদেশ যেন আজ একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে চলছে, যেখানে জীবন অনেকটাই অবমূল্যায়িত, আর মৃত্যু শুধুই একটি রাজনৈতিক টুল। খুন, ধর্ষণ, জখম—এগুলো এখন আর কেবল অপরাধ নয়, বরং রাজনৈতিক ও অপরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হয়ে গেছে। একের পর এক তরতাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, অথচ এসব হত্যার দায় চাপানো হচ্ছে পক্ষ-বিপক্ষের ঘাড়ে। যে সমাজে একে অন্যকে দোষী বানানোর প্রতিযোগিতা চলে, সেখানে দায় বা দোষের বিচার হয় না, হয় কেবল সংখ্যার হিসাব।

একটা খুন হলে কেউ বলে “আমার কর্মী”, আরেক পক্ষ বলে “ও ছিল ওদের লোক”। এরপর শুরু হয় মিডিয়ার গল্প সাজানো, রাজনৈতিক নেতাদের গরম গরম বক্তব্য, মঞ্চের বক্তৃতা, দোষ চাপানোর কূটকৌশল—কিন্তু যে মানুষটা মরে গেল, তার জন্য কি কিছু থামে? থামে না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতা নামে পরিচিত এই সমাজ আরও অসভ্য হয়ে ওঠে। আজ যদি অ্যারিস্টটল বেঁচে থাকতেন, হয়তো বলতেন, “Man is not only a political animal, now he is a political weapon.”

রাজনীতি নয়, এখন চলছে অপরাজনীতি। যেখানে ক্ষমতা রক্ষাই মূল লক্ষ্য, সেখানে নৈতিকতা নিছক একটা শব্দ। টাকার নেশা আর ক্ষমতার মোহে মানুষ দিন দিন অমানুষে রূপ নিচ্ছে। আর এই অমানবিকতার উৎস হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। যখন একজন অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, তখন বুঝে নিতে হয়—আইনের শাসন নয়, চলছে চাটুকারদের রাজত্ব।

আজ সমাজে কেবল খুনিদের হাতেই রক্ত নয়, দায় এড়াতে পারে না দর্শকেরাও। যারা নিরব থেকে এসব খুনোখুনির তামাশা দেখে, তারাও কম অপরাধী নয়। কোনো অপকর্ম থামানোর জন্য হাজারো হাতের দরকার পড়ে না, কয়েকজন সৎ, বিবেকবান মানুষের দৃঢ়তা-ই যথেষ্ট। কিন্তু আফসোস, সেসব হাত আজ ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে। ফলে বারবার জন্ম নেয় দানব, এবং মানুষ পালাক্রমে মরে যায়।

ক্ষমতার পালাবদলে শুধু মুখ পাল্টায়, চরিত্র নয়। প্রতিবারই নতুন কিছু আশা করি, কিন্তু পুরনো নৃশংসতা নতুনভাবে ফিরে আসে। যেন ক্ষমতা মানেই প্রতিহিংসা, আর প্রতিহিংসা মানেই খুন। রাষ্ট্র যদি সত্যিই জনগণের হয়ে কাজ করতে চায়, তাহলে এই রক্তাক্ত রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে।

আমরা চাই না, আর কোনো সন্তান ফ্যালফ্যাল করে তার বাবার লাশের দিকে তাকিয়ে থাকুক। চাই না, আর কোনো মা সন্তান হারিয়ে রাতভর কাঁদুক। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সবার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যদি সেটা দিতে না পারে, তাহলে সব উন্নয়ন, সব অগ্রগতি নিছক প্রতারণা।

আমরা একটি মানবিক রাষ্ট্র চাই—যেখানে আইন হবে অন্ধ, কিন্তু ন্যায়বিচার হবে জাগ্রত। কিসাসের ন্যায়ের মতো কঠোর বিচার ব্যবস্থা চালু না হলে এই খুনের উৎসব থামবে না। আইনের চোখে যতদিন ক্ষমতাবান ও সাধারণ মানুষ সমান মর্যাদা না পাবে, ততদিন মানুষের কোল খালি হওয়া থামবে না।

অপরাজনীতির কালো ছায়া ভেদ করে যদি সত্যিকারের আলোর মুখ দেখতে হয়, তাহলে সংস্কার বিচারকে হতে হবে কঠোর, দৃঢ় এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। সমাজের প্রতিটি দানবকে চিহ্নিত করে থামাতে হবে, নির্মূল করতে হবে অশুভ শক্তিকে।

এই দেশ আমাদের, এই সমাজও আমাদেরমানুষের হাতে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি প্রাণের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব পালনে কোনো গাফিলতি যেন আর না হয়। নয়তো আমরা সবাই ধীরে ধীরে একটা অমানবিকতার অন্ধকারে হারিয়ে যাবো, যেখান থেকে আর কোনো আলো ফিরে আসবে না।

মানুষের সমাজে দানবের স্থান নেই। এখন সময়তাদের চিরতরে রুখে দেওয়ার।