মানুষ নয়, রাজনীতিই এখন সমাজের বিধাতা

53
প্রতীকি ছবি।

বাংলাদেশের প্রত্যেকটি খুন, জখম এবং ধর্ষণ নিয়ে এখন দেদারসে রাজনীতি হয়। সাধারণদের কেউও এখন আর স্বাভাবিকভাবে মরতে পারে না! একদল মরে, আরেকদল মারে। শুধু খালি হয় মায়ের কোল! সন্তান এতিম হয়ে এর ওর মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মিডিয়া মনের মতো গল্প সাজায়। দায়িত্বশীলদের কয়েকদিন গরম গরম আলাপ। তারপর ঝিমিয়ে পড়ে সভ্যতা। আবার আরেকজন খুন হয়। পালাকরে চলছে অসভ্যতামির এই গল্প।

এখন অ্যারিস্টটল বেঁচে থাকলে বলতেন, “Man is not only a political animal, Now he is a political weapon.” ইমাম থেকে শুরু করে পুরোহিত, বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ভাঙ্গারির সোহাগ—প্রত্যেকটা খুনের পেছনে রাজনীতি।  রাজনীতি বললে বোধহয় ভুল হয়- অপরাজনীতি। কোনোভাবে কেউ একজন খুন হলে ঘৃণ্য রাজনীতির কৌশল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ বলে আমার কর্মী, ও বলে অমুকের দোসর! পক্ষ-বিপক্ষের ঠেলাঠেলিতে চাপা পড়ে যায় জীবনের পর জীবন! বাড়ে কবরের সংখ্যা।

খুন হওয়ার পরেই শুনি—স্থানীয় রাজনৈতিক কোন্দল, মাদক বিক্রির এলাকা দখলের ভাগাভাগি কিংবা চাঁদাবাজি ছিল অন্তরালের কারণ! দুনিয়া জানতো, অথচ অপরাধী কেনো জেলে থাকতো না—সেটার কারণ খোঁজা দরকার! অবশ্য অনেক প্রশ্ন তোলাও এখানে এখন বারণ। কখন কে ক্ষমতায় থাকে, কখন কে ক্ষমতায় আসবে—সেসব হিসাব-নিকাশ করে কথা বলতে হয়। অথচ এর মাঝে ঝরে যায় অসংখ্য তরতাজা প্রাণ। একটা বীভৎসতার গল্প আড়াল করতে আরেকটা বিভৎসতাকে সামনে আনা হয়! জোরদার চলে দায় ও দোষ চাপানোর রাজনীতি।  ভোটের জন্যে একজন আরেকজনের কাঁধে দোষ চাপাতে শুরু করে কথার যুদ্ধ। তাতে মানা হয় না মানবিকতার মৌলিক কোনো নীতি! সবকিছুর উপরেই এখন রাজনীতি।

যে মানুষগুলো পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে ওরাই আসল কম কালপ্রিট নয়। আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগেও এভাবেই পাথর নিক্ষেপ করে নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা হতো। আর দর্শকরা উপভোগ করতো। অথচ যে কয়জন অমানুষ অপকর্মে জড়িতে ওদেরকে ছিঁড়ে ফেলতেও উপস্থিত মানুষের সবগুলো হাত দরকার ছিল না। আহারে! মানুষ মানুষকে কীভাবে এমন নৃশংসভাবে আঘাত করে? একজন মরা মানুষকেও উপর্যুপরি আঘাতের দৃশ্য সুস্থতার সুস্পষ্ট বিপরীত।

মানুষ আসলে নেশাগ্রস্ত। এই নেশায় কোনো রাজনীতি, কেউ কারো থেকে কম নয়। টাকার নেশায় মানুষগুলো অমানুষের চূড়ান্তে উপনীত হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই বর্বরতাকে আরও বেগবান করেছে। মানুষের এই অধঃপতন রুখতে পারবে কে?- এই প্রশ্ন আসলে বিবেককে তাড়িয়ে বেড়ায়। কোনোদিন শোধরাবে এই সংস্কৃতি? কোনো সংস্কার এই নৃশংসতাকে রোধ করতে পারবে? দিন দিন আশাহত হচ্ছি। আসলে কী মানুষ হওয়ার পথে কারো কোনো উত্তরণ হচ্ছে? নাকি আখের গোছানোর খেলায় সবাই পালাক্রমে দানব হয়ে উঠবে? নিরীহ মানুষের ভাগ্য কি কোনোদিনই বদলাবে না? কেন সবসময় L.H.S.= R.H.S. প্রমাণ করতে ব্যস্ত থাকবে সবাই?

সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা যুগে যুগেই উপেক্ষিত। ক্ষমতার পালাবদলে মুখাবয়বগুলো আড়াল হচ্ছে, নতুন মুখের আগমন ঘটছে কিন্তু চরিত্র কী আদৌ বদলাচ্ছে? অথচ এতোগুলা মানুষের জীবন তো শুধু পরিবর্তনের জন্য উৎসর্গ হয়েছিল। অথচ হত্যার উৎসব চলছে, চলবে- যেন সব পক্ষ বদ্ধ পরিকর। কতগুলো সাধারণ মানুষের জীবন গেলো, কত সন্তান এতিম হলো, কত স্ত্রী বিধবা- কী লাভ হলো? কত মা যে ঘুমাতে পারছে না তা কি মাহাত্ম্যনদের মাথায় আছে? ক্ষমতা আর টাকার কাছে, দখল ও লুণ্ঠনের সমানে সকল আশা রোজ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এগুলো থামুক- প্লিজ।

মানুষের মুক্তি কি আদৌ আছে? চাঁদাবাজির চিত্রের প্রকাশ্য রূপ সামনে আসছে। নিভৃতে ঘটে যাচ্ছে ক্ষমতা ও সম্পদ সংগ্রহের আরও কত নিরব বিপ্লব! কতটা টের পায় বা বোঝে সাধারণ মানুষ? আঙুল ফুলে কলাগাছের গল্প অধরাই থেকে যায় সাধারণ মানুষের কাছে। দু-চারটে হত্যার চিত্র চোখে পড়ার কারনে মানুষ আঁৎকে ওঠে। অথচ গোপনে দফারফা হয়ে যায় কতকিছুর! বাসস্টপেজ থেকে পাবলিক টয়লেট, পাহাড় থেকে সমুদ্র—দখলদারিত্বের দুনিয়ায় আপনাকে স্বাগতম। ক্ষমতার পালাবদলের সাথে চিত্র পাল্টে যায়, তবে চরিত্র পাল্টায় না। মানুষ মরে, আহত হয় এবং পালিয়ে যায়। অপরাজনীতির অপঘাতে মৃত্যুর মিছিল থামে না। ক্ষমতার জন্য পাগল হয়ে ওঠে সমাজের দুর্বলরাও!

কসাইয়ের বিচার যতদিন কিসাসে কায়েম না হবে, ততদিন খুনিদের এই নারকীয় উল্লাস থামবে না। আইনের চোখে যতদিন ক্ষমতা ও মমতা সমান গুরুত্ব না পাবে, ততদিন মায়ের কোল খালি করার মিছিল বন্ধ হওয়া থামবে না। মবের রাজনীতি, দখলদারিত্বের মনোভাব এবং শোষণ করার টুলসগুলো চিরতরে তুলে দিতে না পারলে—এখানে কেউ নিরাপদ নয়, কেউ না। সংস্কার ও বিচারকে আরও বেগবান করতে হবে। দানবদেরকে আটকাতে হবে। চিরতরে দমিয়ে দিতে হবে অশুভকে।

এখনও খুনিদের প্রেতাত্মারা সমাজে দাপিয়ে বেড়ায়। ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে কাছ এবং দূর থেকে কলকাঠি নাড়ায়। থামাতে হবে এই অশুভ আস্ফালন। সমাজটা মানুষের হতে হবে—তাতে যত কঠোর হতে হয় তা হতেই হবে। রাষ্ট্রের নমনীয়তা মানে মানুষের জান ও মালের অনুধাবন অযোগ্য ক্ষতির পথ সৃষ্টি করা। যে দেশের জনগণের এক ভাগ সভ্য নয়, সে দেশের সরকারের সভ্যতামি মানে অসভ্যতাকে প্রমোট হতে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি। আর কোনো মায়ের কোল খালি না হোক, বোন না হোক ভাই-হারা। সন্তান যেন বাবার আদরে বড় হয় এবং স্ত্রীও আজীবন পায় স্বামীর সোহাগ—এই নিরাপত্তা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতেই হবে। যেকোনো মূল্যে দানবদের রুখে দিয়ে একটা মানবসমাজের গোড়াপত্তন করতেই হবে। মানুষের আশা আলোর মুখ দেখবে না?

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।  

raju69alive@gmail.com