ময়মনসিংহে শিশু একাডেমি ও সত্যজিৎ রায়ের বাড়ী

110
বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ময়মনসিংহ জেলা।

আমি বেশ কিছুদিন ময়মনসিংহ শহরের শিশু একাডেমির জরাজীর্ণ ভবনটির পাশে একটি ফ্ল্যাটে ছিলাম। তখন আমি বেহাল অবস্থায় থাকা এই ভবনটির সামনে দিয়ে প্রাত: ভ্রমণে শশীমহলের প্রাচীর ঘেষে ব্রহ্মপুত্র নদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যেতাম। যেহেতু আমার পিতা দীর্ঘদিন ময়মনসিংহ শহর ও জেলা জুরে অনেক এলাকায় চাকরি করেছেন। তাই আমার কৈশোহতবাক ও র এবং যৌবনের উল্লেখযোগ্য  অনেক অনেক স্মৃতিময় অংশ  এই শহর ও পাশ্ববর্তী  অঞ্চলের সাথে জরিয়ে আছে।

সত্যজিৎ রায়ের বাড়ী শশী মহল এর সামনে দাড়িয়ে ড. ইদ্রীছ ভূইয়া।  ছবি- লেখক

ময়মনসিংহ সহরের প্রাণ কেন্দ্রে জরাজীর্ণ একটি ভবনে অব্যবহৃত অবস্থায় শিশু একাডেমির মত একটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড দেখে হতবাক হয়ে  ও  অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। তাই একদিন অনেক খুঁজে জেলা শিশু একাডেমি কর্মকর্তার কাছে গিয়ে তাদের সাইনবোর্ড ঝোলানো প্রাঙ্গণটির ইতিবৃত্ত জানতে চাইলাম।

তিনি বল্লেন ১৯৮৯ সালে তৎকালীন সেনাশাসক হুসেন মুহম্মদ এরশাদের সময় শীশমহল সংলগ্ন  ওই ভবনটি ব্যবহার শুরু করেছিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমি। বাড়িটি এতই জীর্ণ যে ২০০৭-এর পর থেকে এইটিকে অব্যবহৃত অবস্থায় রেখে সংকুচিত একটি ভাড়া বাড়িতে শিশু একাডেমির কার্যক্রম চালু রাখতে বাধ্য হয়েছিল।

ময়মনসিংহের মত একটি শহরে জরাজীর্ণ একটি প্রাঙ্গণে শিশু একাডেমি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখে ২০০৭ থেকে  ঠাসাঠাসি অবস্থানে শিশু একাডেমি চলছে, এটি শুধু বিস্ময়করই নয় বিবেকবান মানুষের জন্য কষ্টকরও বটে। আমি বিষয়টি শহরের মুক্তিযোদ্ধা সহ সংশ্লিষ্ট অনেককে বলি। এমনকি ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। এই বিষয়টি তাদের নজরে না আনতে পেরে অবশেষে  ফেসবুকে পোস্ট দেই। যার গুরুত্ব অনুভব করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘সিএনএস২৪নিউজ‘ প্রকাশ করে।

দীর্ঘদিন পরে হলেও  সাপ বিচ্ছু  সহ ভয়ংকর বিষাক্ত প্রাণীর আশ্রয়স্থল   এই ভবনটি যেহেতু  কোনভাবেই মেরামত যোগ্য নয়। তাই  ভাঙ্গা ছাড়া বিকল্প কিছুর অপসন নাই।  শিশু একাডেমীর সাইনবোর্ড ঝুলানো জরাজীর্ণ  ভবনটির ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সরকার শিশুদের জন্য কল-কাকলি  মুখর একটি প্রাঙ্গণ নির্মাণ করছেন জেনে আমি খুশি হলেও।

হঠাৎ আনন্দবাজার পত্রিকায় পশ্চিম বঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী  মমতা ব্যানার্জি, যিনি তিস্তা নদীর পানির বাংলাদেশকে একেবারেই ছাড় দিতে চান না, সেই নেতৃর  উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে বিস্মিত ও হতবিহ্বল হয়েছি । ময়মনসিংহ শহর হিন্দু মুসলমান এর মধ্যে সম্প্রীতির অনন্য  দৃষ্টান্ত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন সম্মানিত উপদেষ্টা এই শহরের বাসিন্দা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা।  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্তের  এই শহরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি রক্ষায়  দেশবাসী অত্যন্ত সজাগ থাকা স্বাভাবিক।

আমি যৌবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা  ও যোগাযোগ বিভাগের ছাত্র থাকাকালে  ‘মর্নিং নিউজ’  নামে একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সংবাদ কর্মী ছিলাম। সেই সুবাদে বাংলাদেশের সংবিধান প্রনয়নের পর  দেশের  প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যখন কলকাতা গিয়েছিলেন তখন একটি অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায়ের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনি  আমার ডাইরিতে তার অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন  কিশোরগঞ্জে  তাদের পূর্বপুরুষদের পৈত্রিক নিবাস ছিল, তাই বাংলাদেশের কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে স্মরণ করেন।

বাঙালি সাংস্কৃতিক প্রেমী মানুষ  সত্যজিৎ রায়কে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ভেঙ্গে ফেলবে এটা হতে পারে না। আনন্দবাজারের প্রতিবেদনটি আমাদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে।  আমরা একদিকে যেমন সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা করি তেমনিই এই মাটির বর্ণাঢ্য  ইতিহাসের গল্প শুনিয়ে  শিশুদের বেড়ে ওঠা দেখতে চাই। কোন বিভ্রান্তি ইতিহাস নয়।

ইতিহাসকে বিভ্রান্ত করলে সাংস্কৃতিকে ও সভ্যতাকে বিভ্রান্ত করা হয়। এইরূপ বিভ্রান্তির ফলশ্রুতি সংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বকে ভালোবাসা বা সম্মাননা নয় বরঞ্চ বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে নিঃশেষ করে দেয়া হয়।

লেখক : বীরমুক্তিযোদ্ধা ড.ইদ্রিছ ভূইয়া

এডভোকেট সূপ্রীম কোর্ট, লেখক,কলামিষ্ট। সাবেক কনসালটেন্ট এডিবি ও ওয়ার্ল্ড  ব্যাংক গ্রুপ। idris_bhuiyan@yahoo.com.