জনসংখ্যা থেকে জনসম্পদ: আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও রোডম্যাপ

78

বাংলাদেশ এক জনবহুল দেশ—কিন্তু জনসংখ্যা সবসময় বোঝা নয়। সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তুতি নিলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীই হতে পারে দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। বর্তমানে দেশের প্রায় ৪০% জনগণ ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ এরা কর্মক্ষম। এই যুবসমাজকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে, বিদেশি ভাষায় পারদর্শী করে, আন্তর্জাতিক আইন-কানুন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়ে, এবং প্রযুক্তি ও পেশাগত দক্ষতায় সমৃদ্ধ করে আমরা বিশ্ববাজারে উচ্চমূল্যের জনশক্তি পাঠাতে পারি। এর মাধ্যমে বছরে কয়েক শত বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১৭ কোটি আন্তর্জাতিক অভিবাসী শ্রমিক রয়েছে, যাদের মধ্যে ৩১% এশিয়া থেকে। বিশেষ করে GCC দেশগুলো (সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন) প্রতি বছর নির্মাণ, সেবা, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রযুক্তি খাতে লাখ লাখ নতুন শ্রমিক নিচ্ছে।

ফিলিপাইন: বছরে প্রায় ১ কোটি শ্রমিক বিদেশে চাকুরী করে এবং বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয় করে।

ভারত: বছরে ১.২ কোটির বেশি প্রবাসী রেমিট্যান্স পাঠায়, মোট আয় ১২৫ বিলিয়ন ডলার। যা গোটা বিশ্বে প্রথম।

ভিয়েতনাম: দক্ষতা উন্নয়ন ও ভাষা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ২০২৩ সালে রেকর্ড ৭.৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে বছরে প্রায় ২ কোটি প্রবাসীর মাধ্যমে ২৪–২৫ বিলিয়ন ডলার আয় করছে, যা সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশের এই জনগোষ্ঠী যদি সঠিকভাবে দক্ষ হয়ে এবং ভাষায় পারদর্শী হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের কর্মক্ষেত্রে চাকুরী করত তাহলে তারা কমপক্ষে চার গুণ বেশি আয় করতে পারত।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটি বড় অংশ এখনও কম দক্ষ বা অদক্ষ, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের আয় কম হয়।

তাদের রয়েছে ভাষাজ্ঞান ঘাটতি। তারা আরবি, ইংরেজি, জাপানি, কোরিয়ান ইত্যাদি ভাষায় দক্ষতার অভাবে এবং সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষতার অভাবে তারা আন্তর্জাতিক মানের আয় থেকে বঞ্চিত।

সংশ্লিষ্ট দেশের ও কোম্পানির আইন ও কর্মসংস্থান চুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে শ্রমিকরা প্রতারণার শিকারও হয়।

প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব – যেমন রোবোটিক্স, আইটি, আধুনিক যন্ত্র পরিচালনা এইসব বিষয়ে দক্ষতার অভাবের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তারা প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। ফলে আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি।

আন্তর্জাতিক সনদপত্রের অভাব – যা উচ্চবেতনের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। পর্যাপ্ত যোগ্যতা ও সার্টিফিকেট না থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মের দক্ষতার অভাবে উচ্চতর বেতন পাওয়া যাচ্ছে না।

আমরা সহজেই নিম্নোক্ত সফল মডেল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এ বিষয়ে আরো ডেভেলাপ করতে পারি :

ফিলিপাইন মডেল – সরকার প্রতিটি শ্রমিককে বিদেশে পাঠানোর আগে ৩-৬ মাসের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক অভিযোজন দেয়।

ভারতীয় কেরালা মডেল – বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য সরকারি রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি, সনদপ্রাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং কম সুদের ঋণ সুবিধা।

ভিয়েতনাম মডেল – শিল্পভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র এবং জাপান, কোরিয়া, জার্মানির সাথে সরকারিভাবে চুক্তি।

বাংলাদেশের জন্য রোডম্যাপ :

1. দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র – প্রতিটি জেলায় আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন।

2. ভাষা প্রশিক্ষণ – বাজারভিত্তিক ভাষা (আরবি, ইংরেজি, জাপানি, কোরিয়ান, জার্মান) শেখানো।

3. আইন ও চুক্তি শিক্ষা – আন্তর্জাতিক শ্রম আইন, ভিসা নিয়ম এবং কর্মসংস্থান চুক্তি সম্পর্কে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ।

4. আন্তর্জাতিক সনদপত্র – ISO, OSHA, TESDA, NVQ ইত্যাদি গ্লোবাল সনদ অর্জন নিশ্চিত করা।

5. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব – দক্ষতা উন্নয়ন, বিদেশে কর্মসংস্থান চুক্তি, এবং রেমিট্যান্স নিরাপত্তায় যৌথ উদ্যোগ।

6. ডিজিটাল ডাটাবেজ – বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের তথ্য সংরক্ষণ ও বাজার বিশ্লেষণের জন্য কেন্দ্রীয় ডিজিটাল সিস্টেম।

যদি বাংলাদেশ আগামী ১০ বছরে অন্তত ২–৩ কোটি দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে পারে, এবং প্রত্যেকে গড়ে বছরে ১৫–২০ হাজার ডলার আয় করে, তাহলে বছরে ৩০০–৪০০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আনা সম্ভব। এই অর্থ দিয়ে অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং শিল্পায়নে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত করা সম্ভব।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যাকে জনসম্পদে রূপ দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো দক্ষতা, ভাষা, এবং আইন-জ্ঞান সমৃদ্ধ মানবসম্পদ তৈরি করা। ফিলিপাইন, ভারত, ভিয়েতনামের মতো সফল মডেল থেকে শিক্ষা নিয়ে, সরকারি, বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশ শুধু রেমিট্যান্সে নয়, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের মানচিত্রে শক্ত অবস্থান নিতে পারবে।
এ বিষয়ে এখনই সময় সঠিক পরিকল্পনা করার এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার। সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ জনশক্তিতে বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে পারে এবং অর্থনৈতিকভাবে ঈর্ষণীয়ভাবে সমৃদ্ধশালী হতে পারে।

লেখক: আলহাজ্ব কবীর আহমেদ ভূঁইয়া। রাজনৈতিক, উন্নয়ন কৌশলবিদ ও চেয়ারম্যান, ভূঁইয়া গ্লোবাল ফাউন্ডেশন।