পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস চাই

0
334

পার্বত্য উপদেষ্টা অতি সুন্দর বলেছেন ‘পাহাড়িরা সব সময় একটি স্লোগান দেয় পাহাড় থেকে সেনা হটাও। এই দুনিয়াতে কিছু বাস্তবতা আছে তার বাহিরে আমাদের যাওয়ার সুযোগ থাকে না। এমন দিন আসবে, আমরা চাইলেও সেনাবাহিনী এখানে থাকবে না। এমনও সময় আসবে আমার তাদের জড়িয়ে থাকবো। আবার সময় আসবে, তখন তাদের বলবো চলে যাও। সুতরাং বাস্তবতাকে বুঝতে হবে। শর্ত যখন পরিপূর্ণ হবে, তখন আমরাই অনুধাবন করবো, তারা থাকবে না চলে যাবে।’ শর্ত কিভাবে পূরণ হতে পারে তা নিয়ে কিছু কথা বলা সঙ্গত।

উত্তর পূর্ব ভারতের ছোটছোট রাজ্যগুলি এবং সমতলের মানুষ হাজার বছর থেকে পারিবারিক প্রথায়, সামাজিক শিষ্টাচারে, সমতলের মানুষ হতে সম্পুর্নরুপে ভিন্ন। ভারতের ইতিহাসে অসংখ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন বিশ্লেষণ করলে দেখা পাহাড়িদের জীবন ব্যবস্থার উপর অন্য কোন রাজশক্তি হাত দেয় নাই ।

পাহাড়ীদেরকে উপজাতি বা আদিবাসী যাই বলা হউক কেন তারা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার । আর সমতলের মানুষ পৃতৃিতান্ত্রিক পরিবার। জীবনের গতিপথ বা সভ্যতার প্রতিটি ধাপ শুরু হয় আমাদের থেকে ভিন্ন গতিপথে।

অতএব শিকড় থেকেই তাদের জীবন পথ চলা সমতলের মানুষ থেকে আলাদা। যেমন কখনো তারা গনতন্ত্র চর্চা করে বা ধর্ম নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র বা শাসন ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা করে না। বা তারা করতে পছন্দ করে না।

তারা তাদের অঞ্চলে বাস করত তাদের স্টাইলে।দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন জন্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে বাধ নির্মান করে পানি আটকে দেয়ায় পাহাড়ের ডাল সমুহে তাদের ঝুম চাষে বাধা সৃষ্টি হয়েছে, তাদের জীবন প্রকৃতে আঘাত এসেছে । যদিও ক্ষতিপূরণ দিয়া হয়েছে , তথাপি তাদের ঐতিহ্যগত জীবন ব্যবস্থা ফিরে না পাওয়ায় তাদের মধ্যে যে অসন্তোষের দানা বেধেছে তা ছোট ছোট ইসুতে ক্রমশ ব্যাপক আঁকার ধারন করে ফেলে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরো বাড়বে বৈ কমবে না।

১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত কেন পাহাড়িদের ভিটায় বাঙ্গালী বসানো হলো । কেন শতশত মানুষের প্রাণহানির পরও ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি এখনো বাস্তবায়ন হলো না ? এসব প্রশ্নের কষ্টকর। শাক দিয়ে মাছ যেমন ডাকা যায় না তেমনি শান্তি চুক্তিদিয়ে ওদের ভিটাভূমিতে বাঙ্গালীবসতি উচ্ছেদ করে ফিরিয়ে দেয়া দুস্কর। বাঙালীরা সেচ্ছায় সেখানে যায় নাই। ওরা সংখ্যা ঘরিষ্ঠ হয়েছে দীর্ঘ ৪ /৫ যুগ ধরে অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে নিজেরা অবশেষে বসতি স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে। তাদের অধিকাংশের জন্ম হয়েছে পাহাড়ি অঞ্চলে। ফলে তাদের এখন দ্বিতীয় জেনারেশন চলছে, স্বাভাবতই নিজেদের অবস্থান ছাড়তে চাচ্ছে না।

খাগড়াছড়ির গুইমারার ঐ অষ্টম শ্রেনীর উপজাতি কিশোরীর রাত ৯ টায় পাহাড়ি পথে একা বাড়ীতে ফেরার ঘটনাটি আমার মত অনেকের কাছে স্বাভাবিক মনে হয় না। সরকার বলছে এই ঘটনার অন্তরালে অন্য দেশের ইন্দন আছে । থাকা খুবই স্বাভাবিক, কারন ভারতের প্রায় সবগুলো রাজ্যগুলির প্রতিটি জেলায় পাহাড়ি উপজাতি গোষ্ঠীর সংগঠন আছ। তারা সামান্যতেই স্বজাতির জন্য চিৎকার করে উঠে৷

যদি প্রকৃত অর্থে সমাধানের পথ ধরতে হয়, তবে পাহাড়ি মানুষের পূর্বের সব অবস্থানের পদ্ধতি আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ফিরিয়ে দিতে হতে পারে পাহাড়ের ঝুম চাষের জমির অধিকার। এর জন্য যদি কিছু খেসারত দিতে হয় তবে তা উভয় পক্ষকে দিতে হবে।

সমতলের ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থা এবং পাহাড়ে উপজাতীয়দের ভূমি ব্যবস্থা গোড়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা ভূমির মালিকানা সমাজের হাতে রাখে, ব্যক্তির হাতে নয়। ফলে দলিল,পর্চা,খতিয়ান ইত্যাদির কাঠামো সমতলের অনুরূপ নয়। কোনদিনও সমতল মানুষের সাথে মিলানোও যাবে না। ফলে শান্তির পরিবেশ সচল রাখতে বিকল্প ভাবতে হবে।

১৯৬০ – ৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত কাপ্তাই. মাত্র ২৩০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় কিভাবে সংস্কার করা যায়, ভাববার সময় এসেছে। পানি আটকিয়ে না রেখে ছেড়ে দিলে এই অল্প সংখ্যক বিদ্যুৎ উৎপন্নের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কি করা যায় ভাবতে হবে। পাশাপাশি ভাবতে হবে বাঙালি বসতি নিয়েও।

দেশের ভিন্ন কৃষ্টির মানুষকে একসাথে রাখতে প্রয়োজনে সম্ভব্য ছাটখাট করতে হবে। সামরিক বাহিনী বহিঃশত্রু থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করবে তারা। সেনাবাহিনীর চোখে পাহাড়ি বাঙ্গালী সকলেই সমান এই আস্থাটি যেন পাহাড়িরা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

সামান্য মেগাওয়াট বিদ্যুৎের চেয়ে উপজাতিদের সাথে সমতল মানুষের হাজার বছরের নিবিড় সম্পর্ক অনেক মুল্যবান। সত্যটি উপলব্ধি করতে আজ অথবা অন্য কোন দিন যে,পাহাড়ি চাষিদের জীবনযাপন আলাদা ও বৈচিত্র্যময়। সমতলের কৃষকদের জীবনধারার সঙ্গে পাহাড়ি চাষিদের জীবনযাত্রার অনেক পার্থক্য। সামাজিক রীতি-নীতি, কৃষিকাজের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি ও প্রকৃতি নির্ভরতায় প্রতিফলিত হয়

কৃষিকাজের ধরনে বৈচিত্র্য
ঝুম চাষ (Shifting cultivation) হল পাহাড়ি চাষিদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারা একটি পাহাড়ি ঢাল বা বনভূমি জঙ্গল কেটে-পুড়িয়ে ২–৩ বছর ফসল ফলানোর পর জমি অনুর্বর হলে তারা অন্য স্থানে চলে যায়।

সমতলের চাষিদের মতো স্থায়ী ধানক্ষেত বা জমি তাদের থাকে না। বসতি ও জীবনধারা
অস্থায়ী, অনেক সময় জায়গা পরিবর্তন করতে হয়। পাহাড়ি গ্রামগুলো সাধারণত ছোট ছোট দলবদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ । তারা
প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে জীবন কাটায়।

প্রত্যেক পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, গান, নৃত্য, উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠান আলাদা হয়ে থাকে। ফসল কাটার মৌসুমে তারা বিশেষ উৎসব পালন করে, যা সমতলের কৃষকদের থেকে একেবারেই ভিন্ন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো গ্রাম প্রধানের নেতৃত্বে চলে। তাই ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থা সমতল থেকে একেবারে ভিন্ন। দলিল, পর্চা, খতিয়ান, এস এ- আর এস, বি এস রেকর্ড, সাব রেজিস্ট্রার ইত্যাদি এবং জমি নিয়ে জনে জনে মামলা মোকদ্দমা ওখানে নেই।

ঝুম চাষিরা প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে—বন, পাহাড়, নদী তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঋতুচক্রের সঙ্গে তাদের কৃষিকাজ ও উৎসব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত । ঝুম চাষিদের জীবন অস্থায়ী কৃষিকাজে নিয়োজিত, প্রকৃতিনির্ভর, স্বতন্ত্র সংস্কৃতিসম্পন্ রীতিনীতিতে আবদ্ধ। এই সবকিছুর মর্ম ধারণ করে অবশেষে আমরা বাংলাদেশী, দেশের শতভাগ মানুষ পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস চায়।

লেখক
এডভোকেট সূপ্রীম কোর্ট, কলামিস্ট, সাবেক কনসালটেন্ট এডিবি ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বাংলাদেশ জাসদ।