ভাসবাঃ সংশোধিত চাকরি আইন কেবল দায়িত্ব পালনের বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে—তবুও এটিকে প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ বলা যায়। কারণ, আমরা রাষ্ট্রের সেবক হওয়ার বদলে অধিকাংশ সময় রাজনৈতিক দলের দালাল হিসেবে আচরণ করি। নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের চেয়ে দলবাজিতে ব্যস্ত থাকি। বসের ‘লোক’ নয়, ‘ঘনিষ্ঠ লোক’ হয়ে ওঠাই যেন সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। অফিসে তেলবাজি, নাটকবাজি, দলবাজি— আরও কত ‘বাজি’ চলে নিরবধি; থেমে থাকে শুধু সেবা।
বিগত কয়েকটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালীন দেখেছি, অনেকেই সরকারি দায়িত্ব পালনকালে দলীয় পরিচয়ে প্রভাবিত হন। ভোটার ভোট দিতে চান একটি প্রতীকে, কিন্তু পোলিং অফিসার ভোটারের ইভিএম চালনায় অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অন্য প্রতীকে চাপ দিয়ে দেন। এতে ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। হহবিভিন্ন সরকারি দপ্তরেও সরকারি লোক হয়ে রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। কেউ একটি দলের সরকার গঠনের স্বপ্নে চোখ মুছেন, কেউ আরেক দলের পতনের আনন্দে হাসেন! নিরপেক্ষতা কোথাও নেই। ব্যক্তিগত আবেগ যখন দায়িত্ব পালনের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেবাটা হয়ে পড়ে বিক্রয়যোগ্য।
এই নতুন আইনের ফলে যদি সবাই দায়িত্ব পালনে বাধ্য হন, তবে দীর্ঘদিন ধরে অফিসে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া লোকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হবে। যারা কথায় কথায় অফিস অচল করে দেওয়ার হুমকি দিতেন, তারাও শিক্ষা পাবেন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখনো অবাধ স্বাধীনতার যোগ্যতা অর্জন করেনি। এখানে মানুষকে বলতে দিলে বাপকেও অসম্মান করতে ছাড়ে না, আর মাইক্রোফোন হাতে পেলে কথার লাগামহীন বিস্ফোরণ ঘটে। যারা চাকরিকে নিজেদের জমিদারি মনে করতেন, যারা নির্লজ্জভাবে দলীয় পক্ষাবলম্বন করতেন বা অহংকারভরে বলতেন “আমি অমুক জেলার লোক কিংবা আমি অমুক নেতার লোক”—তাদের মুখ ও হাত এবার সংযত হবে বলেই আশা।
তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে—আইন প্রয়োগ করে যাঁরা, তাঁরা মানুষ; মেশিন নন। তাই সেখানে আবেগ, বিবেক ও মানবিকতাবোধ বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো নিরপরাধ চাকুরিজীবী যেন ব্যক্তিগত রাগ বা লোভের শিকার না হন। কারণ, নিরীহ মানুষের ওপর জুলুম হলে আল্লাহও রুষ্ট হন। চাকরিজীবীদের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করতেই এই আইন এসেছে, যেন দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। একজন চাকুরিজীবী ওপর নির্ভর করে তার পরিবারের সদস্যদের রিজিক। সাবধান, অন্যায় যেন না হয়।
আইন সবসময় অপরাধীর জন্য। যারা সৎ, তারা বিবেক ও বিশ্বাস দিয়ে পথ চলে—নিজে বিপদে পড়ে না, অন্যকেও ফাঁদে ফেলতে চায় না। কথায় কথায় অফিস বন্ধ, আন্দোলন, রাস্তায় নামা আর জনগণকে জিম্মি করার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, সেটি রোধ করাই এই আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য। সরকারি চাকরিজীবী মানে হলো—ব্যক্তিস্বাধীনতার একটি অংশ রাষ্ট্রের শর্তে সঁপে দিয়ে সেবায় নিয়োজিত থাকা। যদি নিজস্ব মত প্রকাশের ইচ্ছা থাকে, তবে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে নেতৃত্বের আসনে যেতে হবে, নীতি পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু দায়িত্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে দায়িত্বহীনতা চলবে না।