সম্ভাবনার স্রোতে ভেসে আসা সোশ্যাল মিডিয়ার সংকট ও চেতনা

50
ছবি- সংগৃহীত

সোশ্যাল মিডিয়ার একটা সাংঘাতিক শক্তি আছে—যে শক্তি টেলিভিশন কিংবা পত্রিকারও নেই। কুমিল্লার বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাতারাতি সারাদেশে জাগরণ তৈরি করেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সিলেটের বন্যায়, উত্তরাঞ্চলে শীতে কিংবা কোনো অসহায়ের পাশে দাঁড়াতেও সোশ্যাল মিডিয়া মারফত তৈরি হয় সৌহার্দ্যপূর্ণ ঐক্য, যা এক ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ, দুর্নীতি প্রতিরোধ কিংবা সামাজিক অনাচার বন্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব হয়। জাতীয় দাবিদাওয়া, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এবং প্রতিবেশী দেশের নানা কার্যকলাপ জাতিকে জানানোর ক্ষেত্রেও সোশ্যাল মিডিয়া অগ্রগামী। হারিয়ে যাওয়া শিশু, লাঞ্ছিত মা কিংবা মজলুম বাবাদের পাশেও নেটিজেনরা সক্রিয়।

প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সবার নাগালে নেই, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আছে সবার হাতের মুঠোয়। যার কাছে মোবাইল ফোন আছে, তার কাছে গোটা দুনিয়া। অন্যায় প্রতিরোধ, অনাচারের প্রতিবাদ এবং অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক গুরুত্বপূর্ণ টুলস। দ্রুত সংবাদ পাওয়া, টিভি ও পত্রিকার সমন্বিত ভূমিকা এবং সহজলভ্যতা—এসব কারণে এর ব্যবহারযোগ্যতা বাড়ছে। মানুষকে সচেতন করা, দেশের কোথায় কী ঘটছে তা জানা এবং বিনোদন পাওয়ার দিক থেকেও মোবাইল-ইন্টারনেট এখন ভাত-জল-ঘুমের মতোই প্রয়োজনীয়।

সোশ্যাল মিডিয়ার সুবিধা অসীম—ঘরে বসে পড়াশোনা, বহির্বিশ্বের খবর পাওয়া, কিংবা কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার মতো নানা আয়োজন এতে রয়েছে। তবে এতে যেমন সত্য তথ্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিপুল পরিমাণ অপতথ্য। সত্যের পাশে গুজবের ট্রেন্ডও প্রবল। ইউজার সচেতন না হলে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়। বিভ্রান্তি, ভ্রষ্টতা ও বিকৃত মানসিকতার সংস্পর্শ পাওয়া এখানে একটি আশঙ্কাজনক বাস্তবতা।

একইসঙ্গে, যে মিডিয়া মানুষের উপকারে আসছে, সেই প্ল্যাটফর্মটিকে এক শ্রেণির কুচক্রী ধান্ধাবাজির জায়গা বানিয়ে ফেলছে। কেউ কেউ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, সম্মানহানি করা এবং মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজে লিপ্ত। শুধু ভিউ ও ডলার ইনকামের জন্য তারা নোংরা কনটেন্ট তৈরি করছে। অসুস্থ কাপল ব্লগ, রুচিহীন কনটেন্ট এবং অশ্লীলতাকে প্রমোট করার মতো কর্মকাণ্ডে সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রিন ভরে উঠছে।

যদিও সুবিধাও আছে। যারা ভালো কিছু খোঁজে, তাদের সামনে ভালো কিছু হাজিরও হয়। কারণ এখানে অ্যালগরিদমের খেলা চলে—মানুষের নিয়ন্ত্রণ সেখানে সীমিত। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতির জায়গা হচ্ছে সময়। বিভিন্ন বয়সী মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, নিজেদের প্রোডাক্টিভ সময় দেদারসে অপচয় করছে।

আমরা বাঙালি—ভাবাবেগের জাতি। যাচাই-বাছাই না করে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো আমাদের ঐতিহাসিক স্বভাব। কেউ যদি আকর্ষণীয় কোনো গুজব ছড়ায়, অনেকেই তা যাচাই না করে শেয়ার করে, মন্তব্য করে এবং খাওয়ার টেবিল পর্যন্ত তা নিয়ে আলোচনা করে। সাম্প্রতিক ধর্মকেন্দ্রিক গুজব, সংখ্যালঘু কার্ডের অপব্যবহার, পরকীয়াকে ধর্ষণ বলে চালানো কিংবা প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া মেয়েকে ‘হারিয়ে গেছে’ বলে প্রচার—এসব ঘটনাগুলো দেশব্যাপী আবেগতাড়িত উন্মাদনা তৈরি করেছিল। যদিও সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকের চেতনা ফিরে আসে, কিন্তু সমস্যা হলো এই চেতনা স্থায়ী হয় না। মানুষ বারবার ভুলে যায়। যাচাইয়ের বোধ না থাকায় গুজব ছড়ায় এবং সত্য প্রকাশের পর নিজেকে ‘জোকার’ মনে হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে যদি ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করা যেত, তাহলে তা হতো এক কল্যাণময় প্ল্যাটফর্ম। এই সময়ে এটি অনেক মাধ্যমের গ্রহণযোগ্য বিকল্প হলেও অপব্যবহারের বিস্তৃতি এতটাই বেড়েছে যে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি দেখা যাচ্ছে।

তথ্য যাচাইয়ের অভাব, গ্রহণযোগ্যতার সংকট, আবেগের তীব্রতা এবং ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তাহীনতা সমাজকে অস্থির করে তুলছে। মুখোশ পরা মানুষদের ছদ্মপরিচয়, শো-অফ প্রবণতা এবং হাসিমুখের ছবিকে সুখ ভেবে নেওয়ার ধারা সমাজে এক ধরনের বিষণ্নতা ছড়াচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত আসক্তি মানুষকে একাকিত্বে ঠেলে দিচ্ছে।

অপার সম্ভাবনার এই ক্ষেত্রটিকে আমরা নিজেদের হাতে ক্ষতিকর এক নোঙর বানিয়ে ফেলেছি। এর ফলাফল খুব শিগগিরই মানুষের চিন্তা, আচরণ ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহভাবে আঘাত হানবে। হয়তো আলামত স্পষ্ট হতেও শুরু হয়েছে।

রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।

raju69alive@gmail.com